নিষ্প্রভার রঙ ফিরে পাওয়া (পর্ব-৫) ॥ ইসরাত জাহান


অলঙ্করণ: কাজী জহিরুল ইসলাম

পর্ব-৫: মাকে হাসপাতালে মেজো খালার কাছে রেখে সাজ্জাদ যখন লিফটে তখন ফোনটা আসে রুদাবার।অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফোনটা রিসিভ করে।
-তুমি কোথায় যাবে?
-নামিব মরুভূমিতে, তুই যাবি?
-সেটা কোথায়? কখন ফিরবে?
-সেটা এই ঢাকা শহরের আশপাশেই, সাইকেলে করে যেতে হয়।চল তোকে নরকের দুয়ার থেকে চা খাইয়ে নিয়ে আসি।
-না, তুমিই যাও।তুমি একটা পাগল।কি যা তা বলো।
-তাহলে পাগলের কাছ থেকে চৌদ্দ হাত দূরে থাকবি।ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে চ্যাটিং করবি না।

অপর প্রান্তের মোবাইল সাথে-সাথে ছেদ টানে আলাপনে।সাজ্জাদ মনে মনে হাসে।ওর এই কাজিন বিভিন্ন ফেসবুক আইডি থেকে কখনো সামান্তা অথবা কখনো জারা নামে ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়।মাঝে মধ্যে একসেপ্ট করে, টুকটাক চ্যাটিংও করে।রুদাবার ছেলেমানুষী আগে বেশ এনজয় করতো।তবে এখন বিরক্ত হয়ে গেছে।অবশ্য এখন আর আগের মতো ভ্রমরকৃষ্ণ হয়ে ছুটে বেড়াতে ইচ্ছে করে না।কোথাও বাধা পড়তে মন চায়, সাজ্জাদের এখন শুধুমাত্র শারমীনের কাছে বাধা পড়তে চায়।

গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে তন্নীকে ফোন করে, আজ বিকেলে ফ্রি আছে কি না।তাহলে শারমীনের ওখানে আসতে বলবে একসাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য।পুরনো বন্ধুদের প্রতি হৃদপটের ভালোবাসাটা টের পায় সাজ্জাদ।শারমীনের সাথে সম্পর্কটা নতুন করে শুরু করতে হলে তন্নীর সাহায্য ওর প্রয়োজন।ভাবতে ভাবতে ফোনটা করে।

-ওই খবর কি তোর? বিয়ে করে তো পুরোপুরি গৃহিণী হয়ে গেলি।কোন খবর নাই।
-নতুন করে সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি, তাই একটু ব্যস্ত।শারমীনের সুখবরটা শুনেছিস?
-কি সুখবর?
-ফেসবুকেই দেখতে পাবি, আমি তো দেখে হতবাক।
-কি বলবি বলতো,এতে রহস্য করিস কেন?
-ফেসবুকে দেখ, পাবলিক পোস্ট তুই দেখতে পারবি।শারমীনকে সবাই কংগ্রাচুলেশন করছে।

তন্নীর তাড়ায় ফেসবুকে উঁকি দেয় সাজ্জাত।সেখানে বেশ বড় করে কে যেন ওকে উইশ করেছে, কংগ্রাচুলেশন লিখে।সাজ্জাদ ভেবে পায়না কি হলো শারমীনের, এত বড় করে অভিনন্দন জানাচ্ছে কেন সবাই ওকে। একটু পরেই চোখ দুটো আটকে যায় আনামিকায় হীরের আংটি পড়ানো একটি হাতের উপর।

অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে শারমীনের ওয়াল।সেখানে একজন লিখেছে,নতুন জীবন আনন্দময় হয়ে উঠুক।

সাজ্জাদ গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে কিছু সময়ের জন্য চুপচাপ গাড়ির ভিতরে বসে থাকে।ল্যাম্পপোস্টের তারে বসে থাকা কাকের চিৎকার, সিকিউরিটি গার্ডের তাড়া কিছুই সাজ্জাদের তন্দ্র ভাঙতে পারে না।পার্কিং জোনের একজন সিকিউরিটি এসে তাড়া দেয় গাড়ি বের করার জন্য, পিছনের গাড়ি বের হবে।অবাক হয়ে গার্ডের দিকে তাকিয়ে থাকি কিছু সময়, গাড়ি জানালায় গার্ডের হাতের করতল ওর মৌনব্রত ভঙ্গ করে।চাবিটা গার্ডের হাতে দিয়ে সাজ্জাদ আবার মায়ের কেবিনের দিকে এগোতে থাকে।

শবমন কিছু সময় পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখে।এই বাড়ির অনেক কিছু বদলেছে।পুরোনো ফ্রিজটা আগের জায়গায় নেই, সেটা জায়গায় নতুন দুই দরজার শার্পের ফ্রিজ এসেছে,পুরোনোটা রান্নাঘরের এককোনায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।শবনমের হঠাৎ করে কেন যেন নিজের রান্নাঘরের ওই ফ্রিজটার মতো মনে হয়।ও তো পুরোনো এই বাড়ির।শিহাব সবসময় শবনমকে পুতুলের মতো রাখতে চেয়েছিলো।প্রথম প্রথম পুতুলই ছিলো, রক্ত মাংসের চাবি দেওয়া পুতুল।শিহাব যা বলতো তাই শুনতো।শাশুড়ির ছায়াসঙ্গী।সকালে শাশুড়ির নাশতা তৈরির সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো, যদি কোন সাহায্যের প্রয়োজন হয়।দুপুরে শাকের ডাটা কেটে ডালের ফোঁড়ন দিয়ে, মাছের লবণের স্বাদ দেখে শাশুড়িকে খুশি করার চেষ্টা করতো।প্রথম প্রথম শাশুড়িও বেশ আদর করতো।সারাক্ষণ কাছেকাছে রাখতো, তার ছেলেকে কিভাবে বৌমা পোষ মানাবে সেই শিক্ষা দেওয়া চেষ্টা করতো।তিনজনের ছোট সংসারে সুখ ছিলো, যতদিন পর্যন্ত শবনম সব বিষয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিতো।বিয়ের ছয় মাস পরে, হঠাৎ একদিন শবনমের স্বামী মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে।সেদিন শবনম নিজের গায়ের নতুন আঁচলকে সরিয়ে জিভটাকে একটু রুদ্র করে স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছিলো,
-প্রতিদিন এত সময় কোথায় থাকো? রোজ দেরি করে বাড়ি ফিরে আসো কেন?

মুখে ঝাঁঝালো গন্ধটা নাকে লাগছে খুব। ওই এক কথায় দুই কথায় ঝগড়া শুরু হয় টোনাটুনির।হঠাৎ নতুন বউয়ের গন্ধ মাখানো শবনমের কাছে অনভিপ্রেত প্রশ্নে শিহাব কিছুটা বিরক্ত হয়ে শবনমকে চড় দিয়ে বসে।বাবা মায়ের অতি আদরের মেয়ে এই চড়টা হজম করতে পারে না। হাতের কাছে থাকা কাঁচের ফুলদানিটা ছুড়ে দেয় শিহাবের দিকে। অবশেষে বউয়ের কাছে কথার যুদ্ধে হেরে গিয়ে শিহাব শবনমের ইচ্ছে বিরুদ্ধে একটু আদর সোহাগ করে।

পরদিন সকালে শবনমের ঘুম ভাঙে তীব্র ব্যাথা কাতর অনুভূতি নিয়ে।শরীরের বিভিন্ন স্থানে অতি ভালোবাসার কারণে জমাট রক্তগুলো ওকে বিদ্রুপ করে।সেদিন অনেকক্ষণ নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে শবনম ভাষাহীন দৃষ্টিতে।রাগে মাথার রগ গুলো দপদপানি টের পায় পানি দিয়ে শরীরটাকে শুদ্ধ করার সময়।

এরপরে অনেকদিন বাক্যলাপ বন্ধ ছিলো ওদের।শিহাব রাগ ভাঙাতে কিছুদিন তাড়াতাড়ি এটা সেটা নিয়ে বাড়ি ফিরতো শবনমের জন্য।বাহিরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো।শাশুড়িও নানাভাবে ওকে পুরুষের নানারূপ সম্পকে জ্ঞান দিতো।নিজের ছেলে যে কত ভালো তা প্রতিপদে পদে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টার কোনপ্রকার কার্পণ্য ছিলো না।স্বামী, যে তো যখন তখন সেক্স করতেই পারে।এই বুঝিয়ে নিজে আবার সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে শবনম।ধীরে ধীরে আবার সবকিছু ঠিক হয়।তবে এরপর থেকে শাশুড়ির সাথে ওর দূরত্ব তৈরি হয়।একটা মেয়ে হয়ে অন্য একটি মেয়েকে সাপোর্ট না করে ছেলের অপরাধকে পুরুষরা এমনই নামক রূপ দেওয়ার কারণে অনেক অভিমান হয় ওর শাশুড়ির উপর।তবে সেটা নিজের ভেতরে চেপে রাখে শবনম।

কিছুদিন পরে আবারও শিহাব তার আগের রূপে ফিরে যায়।ততদিনে শবনম বুঝতে পারে নতুন একজনের আগমন হচ্ছে।আবারও স্বামীর প্রতিটি কর্মকাণ্ড হাতেনাতে ধরে ফেলার কারণে ক্ষ্যাপা হয় মন, যার কারণে শরীর খারাপ করে বারবার।তারপরে ছেলের আগমন।ছেলে হওয়ায় শবনমের বেশ গুরুত্ব বেড়ে যায় সংসারে।তবে ঘরের চাবি দেওয়া পুতুল বউটা চাবি দিয়ে না ঘোরার কারণে সংসারে শুরু হয় আবারও চূড়ান্ত অশান্তি।যার কারণেই শবনমের এত বছরের নির্বাসন।এতদিনে নির্বাসন আবার স্বেচ্ছায় গুটিয়ে আসায় কারণে শবমনের মনে ভেতরে একটু হীনম্মন্যতা কাজ করে।

-মা, দাদী বলে, আমি দাদীর সাতে (সাথে) ঘুমাবো।
-না, তুমি আমার সাথে ঘুমাবে।
-টিত আচে।(ঠিক আছের নতুন রূপ)

ছেলের দিকে তাকিয়ে বেশ মায়া লাগে শবনমের।কতকাল নিজের বাড়িতে আসতে পারেনি।আজ হঠাৎ করে ফিরে আসায় ছেলে যে ওর বেজায় খুশি, সেটা বুঝতে আর বাকি থাকে না ওর।আগে মাঝে মধ্যে একা আসতো বাবার সাথে।অনেক খেলনা নিয়ে ফিরতো সেই সময়।

শারমীন ফোনটা রেখে আবারও বসে মেইল চেক করতে।আজ আবার তাড়াতাড়ি বের হতে হবে।তাই হাতে কাজগুলো গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে একটু তাড়াহুড়োভাবে।তবে ঘড়ি কাটা ওকে তাড়া না দিলেও, পেটের খিদে ওকে জানান দেয় বেলা অনেক হলো, খেতে বসো।

খেতে বসার মুহূর্তেই তন্নি ফোন করে,ফোনটা ধরবে কি ধরব না, সেটা ভাবতে ভাবতে অনেকটা অনিচ্ছার পরও ফোনটা রিসিভ করে।কারণ তন্নি যে এক ঘণ্টার আগে ফোন ছাড়বে না, সেটা ওর বেশ ভালো করেই জানা।
-কি রে,এত বড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেললি একেবারে নিঃশব্দে। একবার কাউকে কিছু না জানিয়ে।সবাইতো রীতিমতো অবাক।তুই আসলেই একটা সাইলেন্ট কিলার।আমাকেও জানালি না, আমি সবার কাছে কেমন অপদস্ত হয়ে গেলাম।সবাই আমাকে ফোন করছে।বলো তোর প্রিয় বান্ধবী তুই কিছু জানিস না, কিভাবে।
-তোর কথা কি শেষ হয়েছে তন্নি? আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিবি।
-না, তুই আর কিছু বলবি না।আমি বলবো, তুই শুনবি।কবে তোর বরের সাথে পরিচয় করাবি আগে সেটা বল।তলে তলে এতকিছু করলি কবে?
-তন্নি, আমি ফোন রাখছি।খেতে বসবো।তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

এই কথা বলেই, শারমীন ফোন কেটে দেয়।ফোনটা কেটে দেওয়ার পরে নিজের আচরণে নিজেই কিছুটা অবাক হয়।তন্নির ফোন কেটে দেওয়ার মতো এতটা অসামাজিক নয়।সবকিছুর জন্য দায়ী যে বোরহান উদ্দিন আর তার ছেলে সেটা বুঝতে আর ওর বাকি থাকে না।আজ ওর মাথার ভেতরে ওরা একেবারে গেঁথে বসে আছে।আর সেই কারণেই মন আর বুদ্ধি আজ একসাথে কাজ করছে না।

পিয়ন সেলিমকে খাবার দেওয়ার কথা বলে, অনুতপ্ত মন নিয়ে ফোন করে তন্নিকে।এইভাবে ফোন কেটে দেওয়া ওর যে ভুল হয়েছে, সেটা মন ওকে বারবার জানায়।

অনেকবার রিং হবার পরে, অপরপ্রান্ত থেকে যে ফোনটা কেটে দিয়েছে তন্নি।সেটা বুঝতে ওর বাকি থাকে না।শারমীন আবার ফোন করে।রাগ ভাঙাতে হবে ওর, তাই। তবে সেটা আর পারে না।চুপচাপ খেতে বসে।

খাওয়া শেষ করে বাসায় ফোন করে, মায়ের উপর সারাদিনের সব রাগ ঝাড়ার জন্য।তিনবার রিং হতেই মায়ের কণ্ঠ শুনতে পায়।
-হ্যালো…খেয়েছিস শামু।(শামু ওর মায়ের আদরের ডাক)
-একদম ঢঙ করবে না, তোমার ঢঙ আমার একেবারে সহ্য হয় না।
-কেন আমি কি করেছি?
-কি করেছি মানে? বলা নেই, কওয়া নেই, বিয়ে ঠিক করে এখন বলছো কি করেছি?
-তোরা দুই বোন কি শুরু করলি? সকালে শবনম রাগ করে চলে গেলো শশুড়বাড়ি।এখন তুই বকছিস,কেন বিয়ে ঠিক করেছি?
আমার ছেলেটা বেঁচে থাকলে আমাকে এত কটু কথা শুনতে হতো না।
-মা একদম ইমোশনাল ব্লাকমেইল করবে না।আর তোমার মেয়ে শশুড়বাড়ি গেছে,বেশ ভালো কাজ করেছে।তুমিই তো চিন্তায় ছিলে কবে আপার সংসার আবার ঠিক হবে।
-তা তো মায়েদের চিন্তা হয়।তুই বুঝবি না।
-কাজের কথায় আসি, বোরহান সাহেব ফোন করেছিলো।আমাকে নিয়ে ওনারা শপিংয়ে যেতে চায়।তুমি নাকি বলেছো,যেতে।
-হুম তোর শশুর ফোন করলো, আমিও না বলতে পারলাম না।
-তুমি কি আমার পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে না।আর কি বলছো এইসব..শশুর।
-শশুরই তো।কয়দিন পরে বিয়ে।
-মা, আমি বিয়ে করছি না।তুমি ওনাদের ফোন করে জানিয়ে দাও।
-আমি পারবো না, তুই জানিয়ে দেয়।

এই কথা বলে ওর মা ফোনটা কেটে দেয়।সকালে দোয়া পড়ে ফুঁ দেওয়া মায়ের কণ্ঠের সাথে দুপুরে ইথারে ভেসে আসা কণ্ঠেস্বরের কোন মিল খুঁজে পায় না।হঠাৎ মায়ের এতটা পরির্বতনের কারণ খুঁজে পায় না।তবে ভাবনায় দাড়ি টেনে উঠে পড়ে ডেস্ক থেকে, নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার জন্য।তখন পিয়ন এসে খবর দেয় গেস্ট এসেছে, সংখ্যায় দুইজন।

চলবে…