মোহাম্মদ নূরুল হক—ছোটগল্প, ছড়া ও কবিতার পাশাপাশি লিখে চলেছেন প্রবন্ধ-গদ্য। তার প্রবন্ধের বিষয় বিচিত্র। সাহিত্যের নানা শাখায় সমান বিচরণ থাকলেও প্রাবন্ধিক ও কবি হিসেবেই পরিচিত তিনি। পেশাগত জীবনে কিছুদিন দৈনিক ইত্তেফাকে সাহিত্য পাতায় কাজ করেছেন। ছিলেন দৈনিক আমাদের সময়ের বার্তা সম্পাদক, নিউজপোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের উপ-বার্তা সম্পাদক, সারাবাংলা’র বার্তা সম্পাদক। বর্তমানে রাইজিংবিডির বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।
সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যবিষয়ক ছোটকাগজ, মেঠোপথ (১৯৯৬ থেকে), চিন্তাসূত্র (১৯৯৬ থেকে), প্রাকপর্ব (২০০০ থেকে ২০০৫) ও অনুপ্রাস (২০০১-২০০৫)। এই পর্যন্ত তার প্রকাশিত কবিতার বই: ‘মাতাল নদীর প্রত্নবিহার’, ‘স্বরচিত চাঁদ’, ‘উপ-বিকল্প সম্পাদকীয়’ ও ‘লাল রাত্রির গান’। প্রবন্ধগ্রন্থ: ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য’, ‘সমালোচকের দায়’, ‘অহঙ্কারের সীমানা ও অন্যান্য’, ‘সাহিত্যের রাজনীতি’, ‘সমকালীন সাহিত্যচিন্তা’, ‘কবিতার সময় ও মনীষার দান’ ও ‘আহমদ ছফার বাঙালিদর্শন ও অন্যান্য’।
প্রবন্ধ সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার-২০২০’।কবিতার জন্য পেয়েছেন ‘দোনাগাজী পদক-২০২১’। সম্প্রতি এক আড্ডায় নিজের লেখালেখি ও পদকপ্রাপ্তি নিয়ে কথাসাহিত্যিক সাইফ বরকতুল্লাহর মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। যোগসূত্রের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি পত্রস্থ করা হলো। সাক্ষাৎকারটি শ্রুতি থেকে লিপিরূপ দিয়েছেন সাওদা সামিহা।
সাইফ বরকতুল্লাহ: গত বছর প্রবন্ধ সাহিত্যে পেয়েছেন বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার। এবার পেলেন কবিতায় দোনাগাজী পদক। আপনাকে অভিনন্দন। কেমন লাগছে পদকপ্রাপ্তিতে?
মোহাম্মদ নূরুল হক: ২০১৫ সাল থেকে বগুড়া লেখক চক্র আমাকে পুরস্কার দিতে চেয়েছে। প্রতিবারই আমি কৌশলে এড়িয়ে গেছি। বলেছি, পুরস্কার পাওয়ার বয়স হয়নি। লেখালেখি শুরু করেছি মাত্র, অন্তত দেড় যুগ লেখার আগে কী করে পুরস্কার নেই? তবে, এবার আর এড়িয়ে যেতে পারিনি। তাই নিয়েছি।বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কারকে বোদ্ধাজন খু্বই সম্মানের চোখে দেখেন। আমিও দেখি। এই পুরস্কার আমার জীবনে প্রথম আনুষ্ঠানিক পুরস্কার, তাই আনন্দ-আবেগও বেশি এই পুরস্কারকে ঘিরে। আর এবার পেয়েছি দোনাগাজী পুরস্কার। এটিও আনন্দের। দুটোই মানুষের ভালোবাসা। ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা। তবে, সবচেয়ে বড় পুরস্কার তো পাঠকের ভালোবাসা। আমি পাঠকের ভালোবাসা পেয়েছি প্রচুর। প্রবন্ধের বইও পাঠকরা প্রচুর কিনে পড়েন, সেটার প্রমাণ আমি পেয়েছি বহুবার। আর কবিতার বইও বিক্রি হয় বেশ ভালোই। তাই বলবো, সব পুরস্কারই ভালোবাসার।
সাইফ: আপনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। আপনার এই তিন পরিচয় পাঠক-গণমাধ্যমকর্মীরা জানেন। আপনি লেখক হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই কলম ধরেছেন? না কি নিছক খেয়ালের বশেই লেখালেখি শুরু? না কোনো স্বপ্নকন্যার প্রেমে পড়ে?
মোহাম্মদ নূরুল হক: লেখালেখির পেছনে আমার বড় ও করুণ গল্প আছে। কিন্তু তার পুরোটা বলবো না। আমি কেবল কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছি বা লিখছি তা নয়। আমার শুরুটা কিন্তু ছড়া ও ছোটগল্প দিয়ে। বেশকিছু ছোটগল্প জাতীয় দৈনিকেও প্রকাশিত হয়েছে।প্রবন্ধ লেখার শুরু অনেক পরে। তাও, চিন্তাসূত্র, মেঠোপথ, অনুপ্রাস ও প্রাকপর্ব নামের এই চারটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করতে গিয়ে লিখতে হয়েছে। মানে ওই সময়ে, সেই ১৯৯৬ থেকে শুরু করে ২০০৯ পর্যন্ত ছোটকাগজগুলোর জন্য বাধ্য হয়ে আমাকে প্রচুর বুকরিভিউ ও প্রবন্ধ লিখতে হয়েছে। এছাড়া দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকদের অনুরোধেও লিখেছি প্রচুর। কখন যে কিভাবে আমার গল্প ও কবিতা ছাপিয়ে প্রবন্ধের সংখ্যাই বেশি হয়ে গেলো, বুঝতেই পারিনি। তবে আমি বুঝতে পারি, যারা আমাকে কবি না বলে কেবল প্রাবন্ধিক বলে, তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই বলে। আমি তাদের কিছু বলবো না। কারণ আমাদের সমাজের একটি কমন স্বভাব হলো, একই ব্যক্তির একাধিক পরিচয় মেনে নিতে পারে না। বহুমুখী প্রতিভাবানকে সহজে গ্রহণ করতে পারে না। তবে, আমি কবিতা-প্রবন্ধ দুটোই মনের আনন্দে লিখি। কোনো পরিচয়েই বিব্রতবোধ করি না।
সাইফ: আপনি তো সাহিত্যের ছোটকাগজ থেকে শুরু করে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করেছেন। আমাদের লেখকদের লেখার মান কেমন? আর আপনি সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করতে গিয়ে যেভাবে কাজ করতে চেয়েছিলেন, ঠিক সেভাবে করতে পেরেছেন কি?
মোহাম্মদ নূরুল হক: দৈনিকের সাহিত্যপাতায় কাজ করতে গিয়ে আমি নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছি। তবে, কোনো রকম আপস করিনি। হয়তো দীর্ঘদিন থাকতে গেলে আপস করতেই হতো। আপস করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির আগেই আমি সাহিত্যপাতার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। আমি একসময় ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতা ছেড়ে আমাদের সময়ের নিউজ এডিটরের দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু আমি নিউজ এডিটর হিসেবে কোনো কোনো বিষয়ে নরম থাকলেও সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে একটুও ছাড় দিতে রাজি নই। তবে হ্যাঁ, ছোটকাগজে যেভাবে সাহিত্যমান বজায় রাখা সম্ভব, দৈনিকে সেভাবে সম্ভব না। দৈনিকের সাহিত্যপাতাটি হলো, ওই পত্রিকার সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ পাতা। বুঝতেই পারছেন, একটি পত্রিকার সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ পাতায় প্রকাশিত লেখার মান আর কত ভালো হবে! দৈনিক বা অনলাইন পত্রিকা যেহেতু গণমাধ্যম, সেহেতু গণরুচির জোগান দেওয়া-ই এসবের মুখ্য উদ্দেশ্য। ফলে সাহিত্যমান আশা করা অবান্তর।
সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করতে গিয়ে দেখেছি, আমাদের দেশের অধিকাংশ কবিযশপ্রার্থী আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন নন। তারা যতটা প্রচারকাঙাল, ততটা আত্মমর্যাদা সচেতন নন। আর দৈনিকের সাহিত্যপাতা যেভাবে সম্পাদনা করতে চেয়েছি, সেভাবে পারিনি।
সাইফ: আপনি তো অসংখ্য বইয়ের আলোচনা করেছেন। অনেক বইকে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছেন, অনেককে নিয়ে মূল্যায়ন করেছেন, এ ক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা কী?
মোহাম্মদ নূরুল হক: অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। যার বই নিয়ে আলোচনা করেছি, তার কাছে আমি মহান লেখক। যার বই নিয়ে আলোচনা করিনি, তার কাছে কোনো জাতের লেখকই না। অনেকেই বলেছেন, আরে রিভিউয়াররা কোনো লেখক নাকি? প্রবন্ধ-রিভিউ লিখতে এসে তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছি বারবার।
সাইফ: লেখকরা তো সমাজ সতেচতন, রাজনীতি সচেতন। রাজনীতির সংকট মুহূর্তে লেখকেরা আগে জোরালো ভূমিকা পালন করতেন। এই ধারা বছর বিশেক আগেও ছিল। কিন্তু এখন জাতির সংকটকালে লেখকদের কোনো জোরালো ভূমিকা চোখে পড়ে না।এর কারণ কী বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ নূরুল হক: জাতির যেকোনো সংকট মুহূর্তে লেখককে এগিয়ে আসতে হয়। এটা সত্য। কিন্তু কোন লেখক? তিনি, যিনি সমাজ-রাষ্ট্রসহ গোটা মানবজাতি কিংবা তারও বেশি বিশ্বের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। লেখককে সমাজসচেতন হওয়ার পাশাপাশি রাজনীতিসচেতনও হতে হয়। তাকে নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের কথা বলতে হয়। এখন পেশাভিত্তিক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। স্বপেশার কেউ হাজার দোষ করলেও অন্য সতীর্থরা তাকে নির্দোষ দাবি করেন। এর কারণ রাজনৈতিক বোধ ও অধিকার সচেতনতার অভাব।
সাইফ: গত ৫০ বছরের বাংলা কবিতার ধারাবাহিক পাঠে কোনো বাঁকবদল দেখতে পান? পেলে সেটা কী রকম?
মোহাম্মদ নূরুল হক: অবশ্যই বাঁকবদল ঘটেছে। অন্তত মোটাদাগে তিনটি। যদিও সেগুলো খুব স্পষ্ট নয়। খুবই ক্ষীণ। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই দেশ পুনর্গঠনের সময় মূলত দেশাত্ববোধক, দেশপ্রেম, দ্রোহ, বিদ্রোহ, প্রতিশোধপরায়ণতা কবিতার মূল বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এরপর এসেছে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। তখন রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি কবিরাও অধিকার সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। লিখেছিলেন রাজনৈতিক কবিতা। দ্রোহের কবিতা। এরপর ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন গণতন্ত্রায়ণের যুগে এসে কবিতায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। জাতীয়ভাবে তো বটে, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর মানুষের বিশ্বাসেও পরিবর্তন আসে। সেই রাজনৈতিক-বৈশ্বিক-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তনে ছোঁয়া লেগেছে বাংলা কবিতায়ও।
এরপর একুশ শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রচুর ভাঙচুরের নামে মূলত শৃঙ্খলাহীনতার চেষ্টা করে যাচ্ছে অধিকাংশ কবিযষপ্রার্থী। মূলধারার কবিতায় এদের কারও তেমন অংশগ্রহণ নেই। তবে, আশার কথা, এর বাইরে আত্মমগ্ন রয়েছেন বিচ্ছিন্নভাবে প্রকৃত কবিরা। যারা পদাবলি থেকে শুরু করে জীবনানন্দ-শামসুর রাহমানের উত্তরাধিকার বহন করছে।
সাইফ: আপনার সমকালীন কোন কোন কবিকে গুরুত্ব দেবেন? আর প্রবন্ধে কারা আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করেন? কথাশিল্পীদের ক্ষেত্রে আপনার মূল্যায়ন কী?
মোহাম্মদ নূরুল হক: সমসাময়িক বা সমবয়সীদের সাধারণত ঈর্ষা করা হয়। কিন্তু আমি কাউকে ঈর্ষা করি না। যা বলি, পরিষ্কারভাবেই বলি। আমার সমবয়সী-সমকালীন কবিদের মধ্যে কাজী নাসির মামুন, জাকির জাফরান, চন্দন চৌধুরী, মনিরুল মনির, তুহিন তৌহিদ, মামুন রশীদ, চাণক্য বাড়ৈ, শামীম হোসেন, ইমতিয়াজ মাহমুদ, ফেরদৌস মাহমুদ, আপন মাহমুদ, ইমরান মাঝি, সিদ্ধার্থ টিপুকে এগিয়ে রাখবো।
আমার সমসাময়িক প্রাবন্ধিক বলতে তেমন বেশি নেই। তবু যারা আছেন, তাদের মধ্যে সবার আগে যাকে স্মরণ করবো, তিনি কাজী মহম্মদ আশরাফ। এরপরই বলবো মামুন রশীদ, রঞ্জনা বিশ্বাস, মোজাফফর হোসেন, কুমার দীপের নাম।
আর গল্পকারদের নাম বলতে গেলে বেশকিছু নাম বলা যাবে। এরা বয়সে সবাই আমার সমবয়সী নন, কিন্তু একইসময়ে লিখতে এসেছি আমরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কাজী মহম্মদ আশরাফ, শিল্পী নাজনীন, রুমা মোদক, ফারহানা রহমান, আনিফ রুবেদ, মোজাফ্ফর হোসেন, রঞ্জনা বিশ্বাস, মেহেদি উল্লাহ, ফারাহ সাঈদ।