রসিকতা ভেবে সাধুবাবার কথা গায়ে মাখেননি তিনি।আস্তানা ছেড়ে কিছুদূর এগোতেই তাঁর মনে হয়েছিল শহর ঘুরে ময়নামতির জন্য একটু কেনাকাটা করে গেলে মন্দ হয় না।তাছাড়া দই-চিড়ার দোকানটায় একবার না ঢুকলে মন কেমন করা থেকেই যাবে।
সেটা ছিল চৈত্র মাসের কোনো দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে আসা একটি সময়।খাঁ খাঁ রোদে ছোট্ট শহরটি খুব ঘামছিল।আলতা, শাড়ি, চুড়ি কিনে বড়ো খান সাহেব ঢুকেছিলেন ব্রহ্মপুত্র নদের পারের ঝুপড়ি দোকানটায়। হালকা হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে নিতে নিতে দই-চিড়ার দুটো থালা সাবাড় করে ফেলেছিলেন তিনি।তারপর ব্রহ্মপুত্রের ক্ষীণ শরীরের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে বসে ছিলেন।তখনই তাঁর চোখে পড়েছিল নদের ওপারের একটি বাড়ি থেকে অস্বাভাবিক ধোঁয়া উড়ছে।
খেয়া নৌকায় নদ পার হয়ে তিনি যতক্ষণে বাড়িটিতে পৌঁছেছিলেন ততক্ষণে পুড়ে গেছিল কয়েকটি ঘর। অবশ্য তারপর আর কোনো ঘর পুড়েনি এবং দ্রুতই আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছিল।
সেদিন শেষ বিকেলের আলোয় পুড়ে যাওয়া ঘরের দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিলেন যে নারী তার দীর্ঘশ্বাস বড়ো কঠোরভাবে তাঁর কানে লেগেছিল। তার অস্ফুট হাহাকার সশব্দে তাঁর বুকে বেজে গেছিল। তার সাদা থানের শোক আর পুড়ে যাওয়া ঘরের কালো দুঃখ তাঁর হৃদয়জুড়ে হঠাৎ মেঘেদের ছোটাছুটির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর তাতে যে কালবৈশাখী ঝড় উঠে গেছিল তার ঝাপটা টের পেয়েছিলেন ময়নামতি।
পরদিন সন্ধ্যার মুখে খান বাড়িতে একটি গোরুর গাড়ি থামলে তা থেকে নেমে অন্য অনেকের সাথে ময়নামতির পা ছুঁয়েও সালাম করেছিলেন সেই নারী। ময়নামতি তখন কোনো কথা বলেননি, এমনকি পরের তিনদিনও না।
তৃতীয়দিন দুপুরে নতুন বউয়ের বাবা তাকে নিতে এলে সবার নিদারুণ উপেক্ষা মুখ বুঁজে সহ্য করা সেই নারী খান বাড়ি ছেড়ে গেছিলেন চিরতরে।মনা যে ছেলেটিকে ভালোবাসে সে সেই নারীর বড়ো ছেলের বড়ো নাতি! সম্পর্কে সে-ও খান বাড়ির চতুর্থ প্রজন্ম, কেবল জন্ম কিংবা বেড়ে ওঠা অন্য কোথাও।
ময়নামতির বুকে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মনা।তিনি পরম মমতায় ওকে আগলে রেখেছেন।তার মন আশ্চর্য স্নিগ্ধতায় ভরে গেছে।সুবহে সাদিকের সময় হয়ে আসছে দেখে বড়ো খান সাহেব ময়নামতিকে ইশারা করলেন। সাথে সাথে যেন সম্বিত ফিরে পেলেন ময়নামতি।মনাকে বুকে নিয়েই উড়ে নেমে এলেন ছাদ থেকে।তারপর আস্তে করে ওর বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটির পাশে ওকে শুইয়ে দিলেন।আর তক্ষুনি হাইস্কুল মসজিদের মুয়াজ্জিন মাইকে দুটো ফুঁ দিয়ে ঘোষণা করলেন, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার।
ছোট্ট একটি খেদ নিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন ময়নামতি, ইশ্, মেয়েটির কপালে একটি আদুরে চুমুও দেয়া হলো না!
মিতা হক শেষ পর্যন্ত আকাশকে রাজি করাতে পেরেছেন মেয়েটিকে দেখতে আসতে।বহু চেষ্টার পর।আকাশ ভালো চাকরি করে।শহরে একাই থাকে।তবু বিয়ে করতে কিংবা বিয়ের প্রস্তুতি নিতেও রাজি হচ্ছিল না কিছুতেই।মিতা হক বুঝতে পারেন ছেলের মনে একটি গভীর ক্ষত রয়ে গেছে।ময়না খানম মনা। তিনি অবশ্য ওদের পালিয়ে বিয়ে করে ফেলার ব্যাপারটায় আর্থিক ও মানসিক সমর্থন দিয়েছিলেন।কিন্তু ডাকাত দলের কবলে পড়ে সে রাতে যা ঘটেছিল তাতে আকাশ-ই আর মনার নাম মুখে নিতে চাইত না।যদিও দু-তিন মাসের মধ্যেই মনার অস্বাভাবিক আচরণের ব্যাপারটা সবাই ভুলে গেছিল।
ওই ঘটনার বছর দুয়েক পর তিনি একবার চেষ্টা চালিয়েছিলেন আকাশের সাথে মনার বিয়েটা পারিবারিকভাবে দিতে, কিন্তু মকবুল হোসেন খান এমনকি রাহেলা খানমও চাননি।
মিতা হকের ছোটো বোন এই নতুন সম্মন্ধটি এনেছেন।তিনি থাকেন সেই মসজিদটির কাছাকাছি যেটার পাশের মোড়ে প্রতি শুক্রবার দাঁড়িয়ে থাকে পূরণ।একটি প্রিয়মুখের খোঁজে; নিজের কিংবা অন্য কারো! যা সে হারিয়ে ফেলেছে হঠাৎ, ওখানেই!
সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে সকাল সকাল ওকে নিয়ে বোনের বাড়িতে হাজির হলেন মিতা হক।উদ্দেশ্য বহুদিন পর ছোটো বোনের সাথে প্রাণখুলে আড্ডা দেওয়া, দুপুর পর্যন্ত।তারপর বিকেলের দিকে মেয়েটিকে দেখতে যাওয়া।আরও একটি উদ্দেশ্য আছে, যা কেবল তিনি আর তার স্বামী আতাউর রহমান তালুকদার জানেন।
মিতা হকের ছোটো বোনের বড়ো মেয়েটিও মাশাল্লাহ দেখতে শুনতে ভালো।এ বছরই কলেজে পা দিয়েছে।তিনি মনে মনে ভেবে রেখেছেন, সুযোগ বুঝে বোন ও বোন জামাইকে প্রস্তাবটা দেবেন।এর গন্ধ পেয়েই তালুকদার সাহেব এ যাত্রায় তার সঙ্গী হননি! তার সাফ কথা, আত্মীয়র সাথে নতুন সম্পর্ক স্থাপনের চেয়ে জঙ্গলে চলে যাব।
মুয়াজ্জিনের ডাক কানে যেতেই মসজিদের পথে পা বাড়াল আকাশ। আসলে সে কোনো একটা উপায়ে তার ছোটো খালার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছিল।এই বাড়ির আজকের পরিবেশ তার কাছে খুব একটা স্বস্তিকর লাগছে না।সবাই কেমন করে যেন তাকাচ্ছে। ফলে জুম্মার আযান ওর জন্য স্বস্তি বয়ে আনল, আর ও সাথে সাথে বেরিয়ে পড়ল।
প্রকৃতি হেমন্তে পা দিয়েছে টের পাওয়া যাচ্ছে।
দিগন্ত জোড়া ধানখেতে শীষ ফুটছে।আর মৃদু হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে তার ঘ্রাণ।শরতের অভ্যেস মেনে ঘন নীল ডানা মেলে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আকাশ।সূর্যবাবু ঢালছে গা-সওয়া রোদ্দুর।তা-ই গায়ে মাখতে মাখতে দু-তিন জনের পরই মসজিদে ঢুকল আকাশ তালুকদার।পূরণের একটু দেরি হয়ে গেছে।আজ ব্রহ্মপুত্রের ওপার থেকে ধানখেতের আলপথে এসেছে সে।দেখেছে, একসপ্তাহের ব্যবধানেই অনেক ধানখেতে শুরু হয়েছে শীষ ফোটানোর উৎসব। আর সেই উৎসবের আমেজে বিভোর ছিল সে।ফলে যতক্ষণে ও বটতলায় পৌঁছেছে ততক্ষণে জনা পাঁচেক মুসল্লি মসজিদে ঢুকে পড়েছেন।অবশ্য সে কারণে ওকে খুব একটা দুঃখিত দেখাচ্ছে না।এখনো শত শত মানুষের মসজিদে আসা বাকি।বেশিরভাগ মানুষের ব্যর্থতা আসে তাড়াতাড়ি আর সফলতা আসতে সময় লাগে ঢেরবেশি!
অন্যান্য দিনের মতোই আজও নামাজ শুরু হতে চললেও সফলতার মুখ দেখতে পেল না পূরণ।গিয়ে বসল বটগাছটির পূর্বমুখী সেই ডালে।এখান থেকে মসজিদের ভেতরের কিছুটা অংশ চোখে পড়ে।আনমনে সেদিকে তাকাতেই একটি মুখ যেন জ্বলজ্বল করে উঠে পরক্ষণেই হারিয়ে গেল ওর চোখ থেকে।একটি ক্ষীণ আশায় সে আরও কয়েকবার ওদিকে তাকালেও আর একবারও মুখটি দেখতে পেল না।
আবার কোনোকিছু ধ্যানজ্ঞানে পরিণত হলে চরম দুর্ভাগাও হয়ত একসময় সফল হবার কোনো পথ খুঁজে পায়, হোক না সে-পথ দুর্গম।
নামাজ শেষে মুসল্লিগণ বেরিয়ে যেতে শুরু করলে পূরণ যেন তেমনি একটি দুর্গম পথের সন্ধান পেল এবং একটি মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সে ছুটে গেল সেদিকেই।
মসজিদ থেকে বেরিয়ে আকাশ তালুকদার সবেমাত্র মোড়ে দাঁড়িয়েছে, তক্ষুনি ছুটে গিয়ে ওর শরীরের ভেতরে ঢুকে গেল পূরণ।আর আকাশের সমস্ত অস্তিত্বে দ্রুত নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে ছড়িয়ে পড়ল।তার ফলে প্রচণ্ড আতঙ্কে এবং যন্ত্রণায় পিচঢালা মোড়ে পড়ে গিয়ে ছটফট করতে লাগল আকাশ।ওর চোখ দুটো জবা ফুলের মতো হয়ে গেল এবং যেন ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাইল।ওর হাত-পায়ের খিঁচুনি দেখে মুহূর্তেই জড়ো হওয়া একদল লোকের অনেকেই বলাবলি করতে লাগল, মনে হচ্ছে মৃগী রোগী।
হ হ, মিরগিঅলা মানুষই!
ঐ, কেউ চামড়ার জুতা ধরো হের নাকে।
হ হ, চামড়ার জুতা হুঙ্গাও! দেখবা অক্ষণ ভালা হয়া যাইব।
একজন খুব উৎসাহ নিয়ে নতুন কেনা নিজের চামড়ার জুতা খুলে দুবার আকাশের নাকে ছুঁয়ে দিল! কিন্তু কোনো কাজ না হওয়ায় অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল জুতাটি।তখনই ভিড়ের মধ্য থেকে একজন ধমকে উঠল, অ্যাই সরে যাও, ওগুলো করা যাবে না।ওসব কুসংস্কার।আরে, এ তো আকাশ! বড়ো ভাইয়ের ভায়রার ছেলে।
মিনিট দুয়েক পর আকাশের অবস্থা আপনাআপনি স্বাভাবিক হয়ে এলো এবং প্রচণ্ড ক্লান্তিতে সে ওখানেই বসে রইল কিছুক্ষণ।
তারপরের তিনটি মাস খুবই এলোপাতাড়ি ছুটোছুটির মধ্যে কাটল আকাশদের।এই ডাক্তার, সেই ডাক্তার; আজ এখানে তো কাল ওখানে! এমনকি ওঝা কবিরাজও বাদ গেল না! কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, কোনো ভালো ফলাফল পাওয়া গেল না! আকাশ তেমনই রয়ে গেল, দ্বৈত সত্তার ঘোরের ভেতর।একটি তার নিজের এবং অন্যটি পূরণের।
টানা তিন মাস ধরেই আকাশের হালকা জ্বর ও বমিবমি ভাব। বেশিরভাগ সময়ই ঠিক করে খেতে পারছে না, আবার কখনো কখনো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খেয়ে ফেলছে! কখনো নিজের স্বরে কথা বলছে, কখনো অন্যের স্বরে। সেই অন্যস্বরটি আতাউর রহমান তালুকদারের চেনা চেনা লাগছে, যেন বহুবার শুনেছেন, কিন্তু ঠিকঠাক চিনতে পাচ্ছেন না।
এই পুরো সময়টায় খুবই ব্যস্ত ছিল মনা। এমবিএর প্রস্তুতি, তারপর পরীক্ষা। সব শেষ করে অনেকটা হালকা হয়ে সে যেদিন খান বাড়িতে ফিরল সেদিনই জানতে পারল আকাশের অমন অদ্ভুত অসুখের কথা! মকবুল হোসেন খান, রাহেলা খানম কিংবা মেহেদী, কেউ-ই ওকে কিচ্ছু বলেনি।
কোথায় যেন একটা টান লাগল ওর।পুরনো-পরিত্যক্ত ঘর হলেও যেমন মন কখনো কখনো আনচান করে একবার উঁকি দিয়ে দেখতে মনার যেন তেমনই বোধ হলো।
সে নিজেকে একটু সামলে নিল।তারপর শেষ বিকেলে রাহেলা খানমকে ডেকে ওর রুমে নিয়ে বলল, মা, আমি তো এখন সব বুঝি, এমবিএ শেষ করে ফেললাম। ওখানে আমার যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল।তোমরা খুব-একটা হস্তক্ষেপ করোনি।বাড়িতেও নিশ্চয়ই আমি তেমন স্বাধীনতা পাব এখন, বল? ততটা ম্যাচিউরড আমি নিশ্চয়ই হয়েছি?
রাহেলা খানম মেয়ের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বললেন, তবু বাবা-মা মরার আগ পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদের সঠিক দিশা দিতে চেষ্টা করে। করে না মা?
আমি তোমাদের অধিকার খর্ব করবার কথা বলিনি মা, আমার স্বাধীনতার কথা বলছি। প্লিজ।
ঠিকাছে, তুই আসলে কী বলতে চাচ্ছিস, সেটা বল।
মনা ওর মা-র কাছাকাছি হয়ে আবেগঘন গলায় বলল, আকাশ এতদিন ধরে এতটা অসুস্থ তোমরা কেউ আমাকে বলোনি! জানি ওর ভুল ছিল। ও আর ওর বন্ধুরা যা করেছিল সবই ভুল।তবুও।ওকে তো তুমি খুবই পছন্দ করতে।ওর অসুখের কথা শুনে তোমার নিশ্চয়ই খুব খারাপ লেগেছে? তাহলে আমি কি করে সব একেবারে ভুলে যাই মা? আর তুমি অন্তত আমাকে জানাতে পারতে ও অসুস্থ! আমি না হয়…. যাক সেসব। মেহেদীকে নিয়ে আমি ওকে একবার দেখে আসি মা?
মেয়ের অভিমান ভরা কথা শুনে ভেতরে ভেতরে কিছুটা চমকালেন রাহেলা খানম।মনে মনে বললেন, কিছু অতীত বড়ো নির্মম হয়।আর বর্তমানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো দৃঢ় মনোবল তোর মা-র অবশিষ্ট নেই মা! মাফ করিস।
মুখে বললেন, মিঠা রে তিতা বানাইতে একটু-ই যথেষ্ট কিন্তু তিতা রে মিঠা বানাইতে অনেক অনেক লাগে মা! তালুকদার বাড়ির সাথে খান বাড়ির সম্পর্ক এখন বড্ড তিতা। তবে তোরে আটকে রাখব সেই সাধ্য আমার নাই। কিন্তু মেহেদী রে না, সন্ধ্যার পর তুই ফুলিরে নিয়ে চট করে একবার ঘুরে আসিস। দরকার হলে একটা রিকশা
নিয়ে যাস।
মনা ওর মা-কে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা!
ফাল্গুনী পূর্ণিমার আগের সন্ধ্যা বলে প্রায় গোলাকার চাঁদটি পূর্বাকাশে নিজের মুখ অনেকখানি তুলে ধরে তাকিয়ে দেখল, ফুলিকে নিয়ে মনা রিকশায় উঠে বসল।গন্তব্য কিলোমিটার খানেক উত্তরের তালুকদার বাড়ি।
আলোর একটি মন্দ বৈশিষ্ট্য হলো, আলোতে দাঁড়িয়ে পাশের অন্ধকারের কিছুই দেখা যায় না। ফলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মেহেদী চেষ্টা করেও দেখতে পেল না যে, হুড তোলা রিকশায় করে কে বেরিয়ে গেল তাদের বাড়ি থেকে। আবার অন্ধকারের একটি ভালো বৈশিষ্ট্য হলো, তার ভেতরে থেকে স্পষ্ট দেখা যায় আলোর সবকিছু। মনা দেখতে পেল, তার ছোটোভাই মেহেদী বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে!
ফুলি-ও দেখতে পেল। সে খলবল করে বলল, আপা, মেহেদী বাই ত’ সিগ্রেট খাইতাছে!
মনা ঠোঁটে আঙুল চেপে ফিসফিস করে বলল, চুপ, কোনো কথা বলিস না!
আসলে ওর মনে অন্যকিছু চলছে। সে বিকেল থেকে পূরণের সাথে ফোনে কথা বলতে চাইছে, কিন্তু ফোন আনরিচেবল বলছে।সবসময় এমনই হয়ে আসছে! ওর সাথে এই বছর খানেকের সম্পর্কে সে নিজ থেকে ফোন করে একবারও ওকে পায়নি! অবশ্য খুব বেশিবার ও আগে ফোন করতে সুযোগ পায়নি।যা দুচারবার ফোন করেছে, বন্ধ পেয়েছে।একদিন তো মুখ ফসকে বলেই ফেলেছিল, যখনই তোমাকে কল করব ভাবি তখনই তুমি কল করো! কীভাবে? তুমি অশরীরী নও তো?
ঠা ঠা হাসিতে সেদিন মনার প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়েছিল পূরণ।
পরে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ভেবেও মনা কোনো কুল-কিনারা করতে পারেনি প্রশ্নটির!
বেশ কয়েক বছর পর তালুকদার বাড়ির সীমানায় পা রাখল
মনা। বড়ো পুকুর, তারপর বৈঠকঘর, তারপর উঠোন পেরিয়ে ওরা আকাশদের ঘরের সামনে দাঁড়াল।
আতাউর রহমান তালুকদার বারান্দায় বসে আছেন। তার শূন্য দৃষ্টি উঠোনেই নিবদ্ধ।দুটো লম্বা ছায়া সেখানে এসে স্থির হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে?
আমি আঙ্কেল।মাথা থেকে ওড়না নামিয়ে ফেলল মনা।
তালুকদার সাহেব চিনতে না পেরে যখন আবারও ওদের পরিচয় জানতে চাইবেন তখনই ঘরের ভেতর থেকে আকাশ অন্যজনের স্বরে ডাকল, মনা, ভেতরে এসো।
চমকে উঠল মনা, পূরণ এখানে!
আরও একবার আকাশের এই কণ্ঠস্বর খুব চেনা চেনা লাগছে তালুকদার সাহেবের।অথচ কিছুতেই মনে করতে পারছেন না, কোথায় শুনেছেন!
তিনি বেশ অবাক হলেন, মনা এ বাড়িতে! দেখলেন, সে স্বচ্ছন্দে ঘরের ভেতরে ঢুকল! তক্ষুনি তার মনে পড়ল আকাশের এই কণ্ঠস্বর হুবহু মনার জ্যেঠামশাই মানে বড়ো খান সাহেবের মতো! কৈশোরে তিনি বহুবার তাঁর ভরাট কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু এত বছর পর আকাশ কী করে তাঁর কণ্ঠে কথা বলছে? নিজের মনে উদয় হওয়া প্রশ্নটি তাকে ভাবিয়ে তুলল।
বারান্দায় ওভাবেই বসে বসে ভাবছিলেন আতাউর রহমান তালুকদার। হঠাৎই একটা অজানা শঙ্কায় কেঁপে উঠলেন তিনি! তারপর মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন।
মিতা হকের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মনা করুণ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কী হাল হয়েছে ওর! সেই ঝাঁকড়া চুলের যুবকের মাথায় এখন ছোটো ছোটো চুল! চোখ কোটরগত আর চোয়াল দেবে গেছে!
মনাকে সামনে পেয়ে ক্রমাগত এটা-সেটা বলে যাচ্ছে আকাশ। কখনো নিজের গলায় আবার কখনো বড়ো খান সাহেবের গলায়!
তালুকদার সাহেব মনা-র সামনে এসে হঠাৎ হাতজোড় করে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমার ছেলেটাকে তুমি মাফ করে দাও মা! ওকে তুমি বাঁচাও! আমি জানি একমাত্র তুমি-ই ওকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারবে!
মনা খুবই বিস্মিত হলো! এসব কি বলছেন আঙ্কেল?…. আপনি হাতজোড় করছেন কেন?…. ছি! আঙ্কেল, আপনি আমাকে পাপী বানাচ্ছেন!
কী করছেন আপনি! মিতা হক স্বামীকে থামানোর চেষ্টা করলেন।
না না, মনা মা শোনো, এই যে আকাশ অন্য একজনের গলায় কথা বলে, স্বভাব বিরুদ্ধ আচরণ করে, এ-সব হুবহু বড়ো খান দাদার মতো! আমি ছোটোবেলায় তাঁকে দেখেছি। ঠিক এভাবেই কথা বলতেন তিনি!
কি বলছেন আঙ্কেল? আশ্চর্য! বিস্ফারিত নয়নে তালুকদার সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে মনা।
কি বলছেন? এ-সব সত্যি? মিতা হক-ও ভীষণ অবাক!
তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে চোখ ছানাবড়া করে ফুলি বিড়বিড় করছে, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালেমিন!
আকাশের বিছানা থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে এলে সবাই একসাথে তাকাল সেদিকে। সে ঘুমিয়ে পড়েছে এবং নাক ডাকছে!
বিস্ময়ের ঘোরে মনা এক পা এগিয়ে ওকে আস্তে করে ডাকল, আকাশ, আকাশ।
কোনো উত্তর না পেয়ে এবার সে ডাকল, পূরণ, পূরণ!
কোনো উত্তর নয়, একটানা নাক ডাকবার শব্দ-ই কেবল ভেসে আসছে।
মিতা হক একটু এগিয়ে মনার বাহু স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করলেন, মনা, পূরণ কে? তুমি কাকে ডাকছ?
মনার ঘোর কেটে গেল। কিন্তু মিতা হকের প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো কোনো কথা সে খুঁজে পেল না!
চলবে..