ডিএনএ ॥ দিলীপ কুমার ঘোষ


অলঙ্করণ: কাজী জহিরুল ইসলাম

সুমিত এখনও পড়ে ফেরেনি? খেতে বসার আগে জানতে চাইল প্রবীর।
না।…সেটাই ভাবছি।এত দেরি তো করে না!…আটটার মধ্যে ফেরে। এখন সাড়ে নটা বাজে।… তুমি একবার সুধাংশু বাবুকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করো না।

এতক্ষণ তুমি একটা ফোনও করোনি! বিরক্তির সঙ্গে সুরভীর দিকে তাকায় প্রবীর।
আরে আমার মোবাইলে ফোন নাম্বার সেভ করা থাকলে তো করব!
ঠিক আছে।…দাঁড়াও… দেখছি।
সুধাংশু বাবুকে ফোন করে প্রবীর।জানতে পারে সুমিত আজ পড়তেই যায়নি।
শুনে সুরভী চিন্তিত স্বরে বলে, মানে…?
মানে আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন? মানে তো তোমরা জানো।… কখন বেরিয়েছে আজ সুমিত?
ঠিক বলতে পারব না।

দারুণ ব্যাপার…! রাত বাড়ছে… ছেলে বাড়ি ফিরছে না অথচ দেখো মায়ের কোনও হুঁশ নেই!… পারো বটে…!
একদম আজেবাজে কথা বলবে না।কে বলেছে হুঁশ নেই?… আটটার পর থেকে ওর মোবাইলে ফোন করেই যাচ্ছি…সুইচড অফ বলছে।আমি আর কী করব বলতে পারো?

হ্যাঁ, কিছু করার নেই ভেবে বসে বসে নিশ্চিন্তে টিভি সিরিয়াল দেখতে পারো! যত্তসব…
প্রবীর শুভকে ফোন করল।বলব-কি, বলব-না করেও সে কথাটা জিজ্ঞাসা করেই বসল–শুভ, তোদের ক্লাসের ওই যে মেয়েটা… সাবিনা, না কী যেন নাম…ওর সঙ্গে সুমিতের কি এখনও রিলেশন আছে?

– কাকু, ঠিক বলতে পারব না।তবে সাবিনার তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।ওর বোন সাহিনা আমাদের সঙ্গে প্রভাত বাবুর কাছে ফিজিক্স পড়তে যায়।ওর মুখেই শুনেছিলাম।…দাঁড়ান, দাঁড়ান কাকু, তাই তো! আমার মনেই ছিল না।আজ সকালে সাহিনা পড়তে আসেনি।পৌষালী বলছিল বটে আগামীকাল সাহিনার দিদির পানচিনি।

প্রবীরের মন কু গাইল।সুমিতের এখনও পর্যন্ত বাড়ি না-ফেরা আর সাবিনার আগামীকালের পানচিনি–এ দুটোর মধ্যে কোনও যোগসূত্র নেই তো! সাবিনা এখন বাড়ি আছে তো!
-তোর কাছে সাহিনার ফোন নাম্বার আছে?
-না কাকু, সাহিনা মোবাইল ইউজ করে না।

প্রবীর মোবাইলে দেখল দশটা বেজে গেছে।নভেম্বরের শেষে শীতও বেশ পড়তে শুরু করেছে। এই সময় এত রাতে সাবিনাদের বাড়ি যাওয়াটা কি শোভনীয় হবে? তাছাড়া সে এলাকাটা চিনলেও সাবিনাদের বাড়িটা ঠিক চেনে না।কলটা কাটার আগেই সুরভী ছুটে এলো।ব্যাপার কিছু বুঝতে পারছি না! তুমি একবার দেখবে এসো।
কী ব্যাপার? কী দেখব?
আরে তুমি সুমিতের ঘরে এসোই না!

প্রবীর সুমিতের ঘরে ঢুকতে সুরভী বলল, দেখো, সুমিত কোনও বই নিয়ে বেরোয়নি।সব টেবিলের ওপর ডাঁই করে রাখা আছে।এদিকে ওর দু’-তিন সেট জামাপ্যান্ট, সোয়েটার-মাফলার-জ্যাকেট আলনাতে নেই।দুটো মোবাইলই দেখতে পাচ্ছি না।এমনকি চার্জারগুলো পর্যন্ত নেই!… ও আলমারিতে যেখানে টাকা রাখত সেখানটা পুরো ফাঁকা!…কোনও টাকা পড়ে নেই।এদিকে সাইকেলটা পড়ে আছে।

প্রবীর সব দেখে-শুনে রীতিমতো ঘাবড়ে গেল।আচ্ছা, ওকে বেরোতে কে দেখেছে?
তুমি ফিরে আসার কিছুক্ষণ আগে মা বলল, ওকে বেরোতে দেখেছে। অবশ্য আলাদা করে কিছু খেয়াল করেনি।আর মা ঠিক মনে করতেও পারছে না কয়টার সময় সুমিত বেরিয়েছে।
-ও, এটা একটা বাড়ি।ছেলেটা কখন বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে, কীভাবে বেরোচ্ছে সেটা দেখার কেউ নেই! অথচ অথচ বাড়িতে তিন-তিনজন লোক বসে আছে।
খোকা, তুই এত মাথা গরম করছিস কেন? এখন মাথা গরম করার সময় নয়।প্রবীর দেখল বাবা এসে দাঁড়িয়েছে।
সুরভী বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি যে পাড়ায় বেরোলে, কোনও খোঁজ-খবর পেলে?
বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘাড় নাড়ল।

প্রবীরের মাথাটা পুরো ফাঁকা হয়ে গেল।সে খাটের বার ধরে দাঁড়াল। সুরভী উদ্বিগ্নস্বরে জানতে চাইল, কী গো, কী হল তোমার?
প্রবীর খাটে বসে বলল, না, কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। ভাবছি এখন কী করব!
বাবা বলল, থানায় একটা খবর দিবি নাকি বলতো?
হ্যাঁ, সে তো দিতই হবে।তার আগে…আমি ভাবছি… একটা জায়গা থেকে একটু ঘুরে আসা দরকার।
মা বলল, এত রাতে কোথায় যাবি? যেখানেই যাস একা যাস না।কাউকে সঙ্গে নিয়ে যা।
এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও প্রবীরের হাসি পেল।কে তার সঙ্গে যাবে? বাড়ির অন্যান্য শরিকদের সঙ্গে বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা ঝঞ্ঝাট এমন একটা পর্যায়ে গেছে কেউ কারও ছায়া মাড়াতে চায় না।তার ওপর তাদের ফ্যামিলিতে একটা এমন স্ক্যান্ডাল আছে যে আশপাশের লোকজনও তাদের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করে না।প্রবীর কোনও ক্লাবে যায় না, পার্টি-পলিটিক্সও করে না।ফলে প্রয়োজনে তার পাশে দাঁড়ানোর মতো বস্তুত কেউ নেই।অফিস কলিগরাই তার একমাত্র বন্ধু।তাই এখন রাতে তার একা বেরনো ছাড়া উপায় নেই।

মোটরবাইক নিয়ে বেরোতে যাচ্ছে দেখল বড় শ্যালক আনন্দ আসছে। সুরভী খবর দিয়েছে বোধহয়।আনন্দ জানতে চাইল, কোথায় যাচ্ছেন?
প্রবীর বলল, গাড়িতে উঠে এসো।যেতে যেতে বলছি।
প্রবীরের গাড়ির পিছনে উঠে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর আনন্দ বলল, কোথায় যাচ্ছেন, বললেন না তো!
জয়রামপুর।
জয়রামপুর…! কী করতে?
আরে চলোই না।গেলেই জানতে পারবে।

প্রবীর মনে করার চেষ্টা করছিল জয়রামপুর থেকে যেদিন সাবিনার বাবা এবং বড়দা তাদের বাড়ি এসেছিল, সেদিন তাদের সঙ্গে ব্যবহারে অপমানজনক কিছু ঘটেছিল কি না।
হ্যাঁ, একটু মন কষাকষি হয়েছিল বটে, তবে কেউ কাউকে অপমানসূচক তেমন কিছু বলেনি বলেই মনে হচ্ছে।

মন কষাকষিও হত না, যদি না সাবিনার বাবা প্রায় হুমকি দেওয়ার মতো করে বলত, আপনার ছেলেকে সাবধান করে দিন প্রবীরবাবু। আমার মেজো এবং ছোট ছেলে কিন্তু খুব রগচটা।কোথাও কিছু ঘটে গেলে কিন্তু আফশোসের শেষ থাকবে না।

প্রবীরের ধাঁ করে মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল।বলেছিল, দোষ তো দুজনেই করেছে।এটা তো আর একতরফা ব্যাপার নয়।আপনি শুধু আমার ছেলের দোষ দেখছেন কেন?
আপনার ছেলের দোষের কথা বলছি না তো! বলছি আপনার ছেলে যেন একটু সামলে-সুমলে থাকে।

প্রবীরের মুখে এসে গিয়েছিল, শুধু ছেলে বলে ওকেই সামলে-সুমলে চলতে হবে, আর আপনার মেয়ের সবেতেই সাত খুন মাফ।কথাটা বলা অভদ্রতা হবে ভেবে চেপে গিয়েছিল।শুধু বলেছিল, কিন্তু দায়িত্ব তো শুধু আমার ছেলের নয়।
না, আমরা আমাদের মেয়েকে সামলাব।কিন্তু আপনার ছেলে যেন আমার মেয়ের পেছনে ঘোরাঘুরি না করে।পরবর্তীতে অবশ্য দুপক্ষই পদক্ষেপ নিয়েছে।সামনে মাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষা থাকলেও প্রবীর সুমিতকে বাংলা-ইংরেজি পড়ার জন্য পঙ্কজবাবুর কাছ থেকে ছাড়িয়ে এনে শুভেন্দুবাবুর কাছে ভর্তি করিয়েছে।টেস্ট পরীক্ষা এবং মাধ্যমিক পরীক্ষার দিনগুলোতে সাবিনাকে ওর বাড়ি একা ছাড়েনি, যাতায়াতের পথে বাড়ির লোক সঙ্গে থেকেছে।এমনকি মাধ্যমিকের রেজাল্ট আউটের দিন স্কুলে সাবিনার সঙ্গে ওর বড়দা এসেছে। তারপর ইলেভেনে তো সাবিনার জন্য ওরা আলাদা স্কুল ঠিক করেছে।

সুমিত এমন ছিল না! বাড়ির ওই ন্যক্কারজনক ঘটনাটার পর সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।আজ সকলের কাছে তারা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের খোরাক উপহাসের পাত্র।পরিবারের মধ্যে এমন নিন্দনীয় ঘটনা ঘটলে তো লোকের কাছে তারা হাসির খোরাক, ঘৃণার পাত্র হবেই।কষ্ট হলেও তাই পাড়া-প্রতিবেশীর প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রবীরের আলাদা করে কোনও অভিমান নেই।আর পাড়া-প্রতিবেশীর কথা বলবে কী, কিছুটা সত্য জানার পর প্রবীরের নিজেরই তো বিবমিষার উদ্রেক হয়েছিল।তার আর খুঁটিয়ে বেশি কিছু জানার মতো মনের অবস্থা ছিল না।বাবা আর সুরভী মিলে এটা কী করেছে! কী করে পেরেছে! দীর্ঘদিন সে রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে বাবার সঙ্গে কথা বলেনি।এখনও সে নিজে যেচে বাবার সঙ্গে কথা বলে না।সুরভীর সঙ্গে সম্পর্কও প্রায় একরকম শেষ হয়ে গেছে। তারপর থেকে তাদের দাম্পত্যে আর কোনওদিন নৈকট্য ফিরে আসেনি। প্রবীর জানে আসবেও না।সব জেনে-শুনে মায়ের তো মাথার গোলমাল দেখা দিল।শুধু মায়ের মুখ চেয়ে প্রবীর আজও এই সংসারে টিকে রয়েছে। নাহলে কবেই সে আলাদা হয়ে যেত।

সংসারের নিয়মে সইতে সইতে প্রবীরের অবশ্য এখন অনেকটা সয়ে গেছে।শুধু চিরস্থায়ী হয়ে গেছে কিছু অনতিক্রম্য দূরত্ব ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে।কিন্তু সয়ে গেলেও মানুষ তো! মাঝে মাঝে একটা চরম সত্য জানার জন্য তার মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়।তার পুত্রের প্রকৃত পিতৃ পরিচয় জানার জন্য সে ছটফট করে ওঠে।তার ইচ্ছা করে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আসল সত্য জেনে নিতে।আবার অস্থিরতা একটু কমলে তার নিজেরই মনে হয়। কিছু সত্য বোধহয় চিরকাল অজানা থাকাই ভাল।বিশেষ করে বিষয়টা যখন অল ইন দ্য ফ্যামিলি!

কী ব্যাপার! কোথায় যাবেন? জয়রামপুর পেরিয়ে যাচ্ছি তো! পিছন থেকে আনন্দর জোরালো গলার আওয়াজে সম্বিত ফিরল প্রবীরের। দেখল সত্যিই সে ইতিমধ্যে জয়রামপুর ফেলে কুশাডাঙার রাস্তা ধরেছে।
গাড়ি ব্যাক করে তারা জয়রামপুর মসজিদের কাছে এসে দাঁড়াল।এখন এখানে কাকে জিজ্ঞাসা করবে প্রবীর ভেবে পেল না।সাড়ে দশটা বাজে। সাবিনা-সাহিনা ছাড়া বাড়ির আর কারও নাম পর্যন্ত জানা নেই। এত রাতে শুধু দুটো মেয়ের নাম ধরে বাড়ির খোঁজ করাটা কি ঠিক কাজ হবে!

আনন্দ বলল, কী ব্যাপার, এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন?
প্রবীর বলল, তুমি নেমে একটু দেখো তো এখানে কাউকে দেখতে পাও কি না।
-এত রাতে এখানে কাকে দেখতে পাব বলুন তো!
-আরে একটু দেখোই না, কাছে পিঠে কোনও বাড়ির বাইরে কাউকে দেখতে পাচ্ছ কি না? এখানে একটা ক্লাবও তো ছিল মনে হয়। সেটাই বা গেল কোথায়! দাঁড়াও, দাঁড়াও, একজন এদিকেই সাইকেল চালিয়ে আসছে মনে হচ্ছে।

সাইকেলটা কাছে আসতে আনন্দ জানতে চাইল, দাদা, এখানকার ক্লাবটা কোথায় বলুন তো?
সাইকেলে বসা লোকটি বলল, আমার সাথে আসুন। আমি ক্লাবের সামনে দিয়েই যাব। সাইকেলের পিছন পিছন তারা ক্লাবের সামনে গিয়ে পৌঁছল।
ক্লাবের দরজা ভেজানো ছিল।একটু ইতস্ততঃ করে প্রবীর দরজায় কড়া নাড়ল।দরজা খুলে একজন জানতে চাইল, কী ব্যাপার? কাকে চাই?
প্রবীর বলল, আমরা একটু একজনের বাড়ি খুঁজছি।

ভিতর থেকে একজনের গলা পাওয়া গেল, কে রে ওমর? কী হয়েছে? তারপর সে বেরিয়ে এসে জানতে চাইল, কী ব্যাপার?
প্রবীর বলল, আমার বাড়ি বলরামপুর।আমার নাম প্রবীর চ্যাটার্জী আসলে একটা সমস্যা হয়েছে আমি ভদ্রলোকের নাম জানি না। ভদ্রলোকের দুই মেয়ে এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। সাবিনা, সাহিনা।আমি তাদের বাড়ি খুঁজছি।

ছেলেটি খুঁটিয়ে দেখতে লাগল প্রবীরকে। তারপর বলল, এত রাতে কী নাম বললেন আপনার? প্রবীর চ্যাটার্জী? চ্যাটার্জী…! আচ্ছা, আপনি কি সুমিতের বাবা?
প্রবীরের মনে একই সঙ্গে আশা এবং আশঙ্কা দেখা দিল।সে ধীরে ধীরে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল।ছেলেটি চাপাস্বরে জানতে চাইল, আপনার সাবিনা-সাহিনাকে কী দরকার বলুন তো?
দরকার? আছে।তুমি ভাই একটু ওদের বাড়িটা দেখিয়ে দাও না।
আগে দরকারটা বলুন। আমি ওদের মেজদা সেলিম। আমার বাবার নাম সাদিক মোল্লা।
প্রবীর একটু থতমত খেয়ে গেল।ভেবে পেল না কী বলবে।
আনন্দ প্রবীরের পাশ থেকে বলল, আসলে সুমিত সেই বিকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। এখনও ফেরেনি।তাই আমরা সুমিতের খোঁজে বেরিয়েছি।

সেলিমের গলায় বিরক্তি ফুটে উঠল, সুমিতের খোঁজে বেরিয়েছেন তো এখানে কী করতে এসেছেন? জানেন না, কাল সাবিনার পানচিনি?
প্রবীর বুঝতে পারল সাবিনা বাড়িতেই আছে। সুতরাং সে যে আশঙ্কা করছিল তা সত্য নয়! তাহলে সুমিত একা গেল কোথায়!
প্রবীর অনুনয়ের সুরে বলল, যদি কিছু মনে না করো, একবার… তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে? আমি একবার সাবিনার সাথে কথা বলতাম।

দেখুন, বুঝতেই তো পারছেন, কালকে বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান।বাড়িতে কয়েক জন আত্মীয়-স্বজনও এসেছে।সেলিমের গলায় স্পষ্ট অনিচ্ছা।
প্রবীর একবার মরিয়া চেষ্টা করল, দেখো, আমাদের বাড়িতে একবার তোমার বাবা এবং বড়দা গিয়েছিলেন।আমাকে ওনারা চেনেন।একবার যদি আমাকে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে বড় উপকার হত।বুঝতেই তো পারছ, বড় বিপদে পড়ে এসেছি।

সেলিম একটু সময় নিল।তারপর কী ভেবে বলল, ঠিক আছে।এত করে বলছেন যখন চলুন।
সেলিমকে অনুসরণ করে বাইকে যেতে যেতে প্রবীরের মনে হল, সুমিত তারই ছেলে।তারই মতো ভীরু, কাপুরুষ।সে-ও তো বন্দনাকে কথা দিয়ে বাড়িতে বাবার চাপে কথা রাখতে পারেনি।বাবা কিছুতেই নীচু জাতের মেয়ের সঙ্গে প্রবীরের বিয়েতে রাজি হয়নি।প্রবীর ভেবেছিল বন্দনাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে।কিন্তু শেষ মুহূর্তে পালিয়ে যাওয়া তার সাহসে কুলোয়নি।এদিকে কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে হবে জেনে তারা দুজনে অবাধে মেলামেশা শুরু করে দিয়েছিল।তারই ফল বন্দনার গর্ভসঞ্চার। কিন্তু এরকম সঙ্কটজনক অবস্থায় দাঁড়িয়েও প্রবীর চরম সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ হয়।লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে বন্দনাকে শেষমেশ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে গর্ভপাত করাতে হয়।খরচ-খরচা অবশ্য প্রবীরই করেছিল।এই ঘটনা তাকে এখনও কুড়ে কুড়ে খায়।প্রবীর ভেবে একটু অবাকই হল তবে কি তার অবচেতনে একটা অন্য ইচ্ছা দানা বাঁধছিল, একটা অন্য ভাবনা খেলা করছিল! সেই ভাবনা অনুযায়ী সুমিত যদি সাবানাকে নিয়ে পালাত, তাহলে বাবা হিসাবে তার হয়তো খুব খারাপ লাগত, কষ্ট হত; কিন্তু মানুষ হিসাবে একটা প্রায়শ্চিত্তের বোধ তাকে হয়তো একটু শান্তিও দিত।

সাদিক সাহেব সব শুনে বলল, প্রবীর বাবু, বুঝতে পারছি আপনার পরিশানি।আমিও তো সন্তানের বাবা।আপনার মুখ চেয়ে আমি সাবিনাকে ডাক করাচ্ছি।কিন্তু বুঝতেই পারছেন কালকের অনুষ্ঠানটার গুরুত্ব! আপনি দু-একটার বেশি প্রশ্ন করে আর বাচ্চা মেয়েটাকে বিরক্ত করবেন না।
সাবিনা-সাহিনা দুবোনই এলো।সাদিক সাহেব সাবিনাকে চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করল।সাবিনা চেয়ারে বসল।সাহিনা চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে রইল।প্রবীর চোখ তুলে সাবিনার দিকে তাকাল।প্রথমেই চোখে পড়ল মেহেন্দি করা দু-খানা হাত, তারপর মুখ।সাবিনার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল প্রবীর।মেয়েটি ভীষণ আকর্ষণীয় তো! স্নেহান্ধ পিতার দৃষ্টির বদলে প্রবীরের দৃষ্টিতে ক্রমশ ফুটে উঠতে লাগল চিরন্তন পুরুষের দৃষ্টি।সাবিনা তার দিকে তাকাতে অস্বস্তি বোধ করল।প্রবীর লজ্জা পেল, বিশেষ করে এটা ভেবে-এই সাবিনা তার বৌমা হতে পারত!

সাবিনা বলল, দেখুন কাকু, আমার সাথে মাধ্যমিকের আগে থাকতেই ওর সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে।
সাহিনা বলল, আপনারা হয়তো জানেন না, আমাদের সঙ্গেই পড়া নার্গিসের বাড়িতে সুমিতের যাতায়াত ছিল।কী ঘটেছিল, বলতে পারব না।তবে কাল নার্গিসের পাশের বাড়ির তহমিনা বলছিল, বাড়ি থেকে নার্গিসের স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে এবং খুব তাড়াতাড়ি নাকি ওর বিয়ে দিয়ে দেবে।নার্গিসের ছোটদা দু-তিন দিন আগে সুমিতকে মারধরও করেছে। নার্গিসের বিয়ের আগে ওকে যেন ত্রিসীমানায় দেখতে না-পাওয়া যায়-এই বলে হুমকিও দিয়েছে।

বাড়ি ফেরার পথে দুশ্চিন্তা ছাপিয়ে প্রবীরের কোথাও একটু খারাপই লাগছিল।ছেলেটা ভালবাসার টানে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারল না! শেষ পর্যন্ত অন্যায় করে ভয়ে বাড়ি ছাড়ল।

প্রবীরের নিজের কথাও মনে পড়ল।আর… আর… তার মনে হল… এরপর সুমিত বাড়ি ফিরলে আর কারোরই কোনও সায়েন্টিফিক টেস্ট-ফেস্টের প্রয়োজন নেই… অল ইন দ্য ফ্যামিলি।