যেভাবে ছোটবেলায় বই চুরি করা শিখে চুরি করে বইয়ের ভেতরেই থেকে গেলাম ॥ নাসরিন জে রানি


অলঙ্করণ: লংরিড

একটি বই একজন অনাঘ্রাত প্রেমিকের মতন।যতক্ষণ বইটি পড়ি- প্রেমিকের সঙ্গে প্রথম দৃষ্টি বিনিময়, তার ভাবের সাথে আমার ভাবের রঙ-মিলান্তি, ও পরবর্তীতে সম্মুখাভিমুখ ঐকান্তিক-আবেগ-জড়োয়া রোমান্টিক পর্বে প্রবেশ করে এক প্রকারের লিভটুগেদার শুরু করে দেই। এর ভেতরে কোনো কোনো বই এসব না হতে চাইলে ভালো বন্ধুও হয় তারা- বহু বছর আমার পাশে পাশে থাকে।সমস্যা হলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, সমাধান দেয়। না পারলে শান্তির খোঁজ দেয়। বিশেষ করে দর্শনশাস্ত্র বা মেটাফিজিক্স বিষয়ক হ্যান্ডসাম বইগুলো।তবে কোনো কোনো বই সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির হয়।এরা কথায় চরিত্রে ব্যক্তিত্বপূর্ণ বিদ্যাঙ্গ যেমন, তেমন সুদর্শন ও সুদেহী, দুঃসাহসী, যৌন প্রলোভনসংকুল মাদকতায় পূর্ণ হয়ে আমার সম্মুখে উপস্থিত হয়। বিশেষ করে একশন থ্রিলার বইগুলো, হার্ড-বয়েল্ড ক্রাইম নভেলগুলো।বহু প্রাইভেট ডিটেকটিভের প্রেমে পড়লাম এই ছোট্ট জীবনে।বিশেষ করে ফিলিপ মার্লো, স্যাম স্প্যাড, পেরি ম্যাসন, হাল আমলের এলেক্স ক্রস, জেমস বেনেট থেকে শুরু করে এমন কি এক ভিলেন বা ক্রিমিনাল ফ্রেডি জনসনের প্রেমেও পড়লাম।

ছোটবেলা থেকে প্রচুর গোয়েন্দারা আমার মন কেড়ে নিয়েছে।তাদের সঙ্গে বেড়াতে নিয়ে গেছে বিচিত্র স্থানে, একশনেও নেমেছি। সাথী হয়ে লড়েছি।অবশেষে নির্জনে অবসর কাটিয়েছি পৃথিবীর বিবিধ প্রান্তে তাদেরই সঙ্গে।তবে সবচেয়ে বেশি প্রেমে পড়েছিলাম আমি তিন গোয়েন্দা সিরিজের রবিন মিলফোর্ডের, সেই কৈশোরের প্রেম এখনো অটুট আছে। আজকাল নিজেও গোয়েন্দা সিরিজ লেখার কথা ভাবছি- একজন সাধারণগোছের বাংলাদেশি মাঝবয়েসী নারী গোয়েন্দা, তাকে নিয়ে সিরিজ গল্প লেখার কাজে হাতও দিয়েছি।

সে যাই হোক, আজ বিশ্ব বই দিবসে বই পড়ার কথাই বলা দরকার বেশি করে। ইদানিং যা পড়ছি তার মাঝে প্রাইভেট ডিটেকটিভ পেরি ম্যাশনকে ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে এলেক্স ক্রসের সাথেও ডুব মারি।তবে এসব যখন বেশি বেশি ঘটে গিয়ে থ্রিলার সমুদ্রের এই অতলে তলিয়ে যাই- তখন আমেরিকান নারী গোয়েন্দা লিন্ডসে বক্সার এসে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।বিপদের অগ্নিমুখ থেকে ফিরে এসে আফ্রিকা মহাদেশের বতসোয়ানার নারী গোয়েন্দা মামা প্রিসার রামাৎসয়ে সাথে বসে একটু সুখ দুঃখের আলাপ করি। কেন যেন আমার সব সময় মনে হয়- মানুষের জীবনে দুঃখের চেয়ে দুঃখ নিয়ে বরং দুঃখী দুঃখী আলাপই বেশি সুখের অনুভূতি দেয়।

কৈশোরে যত বই পড়েছি তার সিংহভাগ ছিলো চুরি করে আনা গল্পের বই এবং সেই বইগুলো পড়ার পরে নিয়ম করে ফেরতও দেওয়া হত।এই নির্বিঘ্নে চালিয়ে নেওয়া কুকর্মটির জন্য জন্য স্কুলে একটা নিজস্ব দল বানিয়ে নিয়েছিলাম-মর্গ্যান স্কুলের গোয়েন্দা বাহিনী।আমাদের দলটা ছিলো চারজনের।একজন ছিলো মুটোগুট্টু কিন্তু ভীষণ মেধাবী ও পড়ুযা যে খেতেও ভালোবাসত। আরেকজন আবার প্রেমিকা স্বভাবের ও দারুণ রূপসী কিন্ত পাঠে মন নেই। তৃতীয়জন ছিলো চতুর এবং সবশেষ লোকটি ছিলাম আমি এসব কিছুর তত্ত্বাবধানে ও পরিকল্পনায়।আমার চরিত্রটির নাম দিয়েছিলো ওরা কিশোর পাশা, ভোটাভুটি করেই।পুরো স্কুলজুড়ে বিভিন্ন ক্লাসের মেয়েদের বিচিত্র সমস্যাগুলোর সমাধান করতাম আমরা। তবে ক্রাইমও করতাম টুকটাক।স্কুল শুরুর আগে ও পরে টাউনহলের বুক লাইব্রেরিগুলোতে ঢুঁ মেরে ছোকরা বিক্রেতাদের সঙ্গে ‘লাভ-টিল্লো-এক্সপ্রেস’ গেম চালাতাম।

৯০ এর সেই যুগে দুনিয়া ছিলো সরল; সামান্য একটু হাসি, আর দোকানির হাত থেকে বই ধরতে যেয়ে আমাদের আঙ্গুলের ওদের আঙ্গুলের ঠোকাঠুকিতেও এক সপ্তাহ বুদ হয়ে থাকা যেত দুইপক্ষেই।আমাদের চারজনের টিমে দুজন ফ্রন্ট-প্লেয়ার আর দুজন ছিলো প্রক্সিদাতা।ফ্রন্ট প্লেয়াররা ব্যস্ত রাখতো দোকানি ছোকরাদের চোখে চোখ ধরিয়ে রেখে। ঠোটে গুনগুন গান আর তুচ্ছ কথায় মেতে মিস্টি খিলখিলে অর্থহীন হাসাহাসি দিয়ে। আর বাকি দুজন বই বাছাই করে চুরি করতাম। আর আগের সপ্তাহে চুরি করে নেওয়া বইগুলো, পায়জামার গোজ, বা পিঠের পেছন থেকে অথবা পেটের সামনে থেকে এবং ক্রস করা সাদা ওড়নার ভাজ থেকে বের করে তাকে সাজিয়ে রেখে দিতাম। ছোকরা দুটো দোকানের মালিক নয় বরং কর্মচারী।ওরা কি বুঝত কে জানে।তবে এই হাসাহাসিতে ওরা যেন মোম গলা হয়ে কোথাও ভেসে যেত, প্রেমের চেয়ে প্রেমের ভাব বেশি মারাত্মক আফিমের মতন। নেশা ধরিয়ে রাখে- অসম প্রেমে।

বই পড়ার জন্য কি-না-করেছি।স্কুলে যখন পড়তাম ব্যবসায়ী বাবা প্রতিদিন দুপুরে বাড়িতে ফিরে খেয়ে দেয়ে ভাত-ঘুম আর বিশ্রাম নিতেন যখন, তার মাথা টিপে দিতাম কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে, এমন কি মাঝে মাঝে পিঠে চড়ে- বাবার পিঠের এমাথা ওমাথা মাড়িয়ে দিতাম। এরকম একেক সেবার পারিশ্রমিক ছিলো একেক রকমের।সেই অর্থ দিয়ে গল্পের বই কিনতাম, রাশান লিটারেচার, রাদুগা প্রকাশনীর বা সেবার বই।তবে আমার মা ভীষণ জাদরেল মানুষ ছিলেন।পড়তে দিতেন না এসব।পড়ালেখায় ভালো ছিলাম। কূটবুদ্ধিও কম ছিল না। মাকে ফাঁকি দিয়ে পাঠ্যবইয়ের ভেতরে গল্পের বই লুকিয়ে মায়ের সামনের খটোমটো শক্ত চেহারা বানিয়ে রেখে স্কুলের পড়া মুখস্ত করতাম। একই প্যারা পড়তাম বারবার। মা বুঝতেন না শুরুতে কিন্তু যখন একদিন ফাঁকিবাজি ধরা পড়ে গেলো- সেদিন থেকে এক সপ্তাহ চলত আর্মি ড্রিলিংয়ের মতন মায়ের সব কথার পালন। আমার মনে হয়- আমার মা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নারী গোয়েন্দা, আর আমি তার অপরাধী। কিছুতেই মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়।মায়ের সেই শাসনের ভয় এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি।

এখন আর বই চুরির সুযোগ নেই।আমার সেই চার গোয়েন্দা মেয়েবন্ধু দলের একজন স্কুলের পরেই এক দূরারোগ্যব্যাধীতে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে অন্য দুনিয়ায় চলে গেছেন।আরেকজন প্রবাসী হয়েছেন দেড়যুগ আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে। আর সবচেয়ে প্রিয়জন কোথায় আছেন জানি না। শুনেছি সে বড় ডাক্তার হয়েছেন।আর আমি এখনো বই কিনি, প্রচুর প্রচুর।এই মাসেও কিনেছি নব্বইটির মতন বই।তবে এই মাসে থ্রিলার সিরিজের বই কিনেছি- বৃটিশ ক্রাইম ফিকশন কুইন মার্টিনা কোলের লেখা মোট তেরটি বই। এবং সমান তালে আমেরিকান বেস্টসেলার থ্রিলার রাইটার জেমস প্যাটারসনের লেখা পনেরটি বই। এই দুই দেশি থ্রিলারগুলোর সবগুলোই অরিজিনাল বই এবং ফার্স্ট এডিশন, কালেক্টর এডিশনই বলা চলে (এবং যেহেতু বর্তমান সময়ে একজন বেকার লোক, লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি) এইবার সমস্ত পয়সা চুরি করেছি স্বামীর মানিব্যাগ থেকে।এই লেখা যখন লিখছি রেডএক্স ডেলিভারিশপ থেকে আরও পাঁচটি বই ডেলিভারি আসছে। তাদের মেসেজ এসেছে–‘ডিয়ার কাস্টমার উই রিসিভড এ পারসেল ফ্রম বুকেন্ডস লিমিটেড অ্যান্ড উইল ডেলিভারি সুন।ট্র্যাক আস হিয়ার উইথ দিজ লিংক বিলো- রেডএক্স।’

আমার গল্পের সমাপ্তিতে- আজ বিশ্ব বই দিবসে, দেশি-বিদেশি কিছু লেখকের বই নিয়ে কথকতা ও আলাপন তুলে দিলাম। বই আমাদের সবকিছুর মূলে থাকুক। বই থাকুক প্রাণ হয়ে, আমরা হই বইগুলোর হৃদয় ও আলােকবর্তিকা।

বই কী– এই ভাবনার প্রকাশ নিয়ে সমসাময়িক বাংলাদেশি কতিপয় লেখক-কবি-পাঠকের জল্পনা
১।বই একটা বস্তু।অনুবাদের কাজে লাগলে পড়ি।
– অনুবাদক মাহমুদ আলম সৈকত
২। বই মানে প্রশান্তি।আনন্দ।জ্ঞান।
– কবি এলাহি আসিফ।
৩। সুস্থ থাকতে বই পড়ি।
– গল্পকার সাইফ বরকতুল্লাহ।
৪।বই হলো ভালোবাসা।শান্তি।আনন্দ।জ্ঞান।
– কবি নাফিসা ইসলাম।

বিদেশি লেখকরা বই নিয়ে কী বলেছেন
1. A half-read book is a half-finished love affair.
– david Mitchell.
2. If you tell me the heart of a man, tell me not what he reads, but what he rereads.
-Francois Mauriac
3.Wear the old coat and buy the new book.
-Austin Phelps.
4.Reading one book is like eating one potato chip.
-Diane Duane.
5.Writing comes from reading, and reading is the finesr teacher of how to write.
-Annie Proulx.
6. Reading brings us unknown friends.
-Honore de Belzac
7.Show me a family of readers, and i will show you the people who move the world.
– Napoleon Bonapart.
8. Read. Read. Read. Just dont read one type of book. Read diffrent books by various author so that you develop diffrent style.
– R. L. Stine.