সিরিজ কবিতা শেষ বিকেলের গান ॥ কাজী জহিরুল ইসলাম


সিরিজ কবিতা শেষ বিকেলের গান

১৬.
পৃথিবীতে ধরো কোনো ক্যামেরা নেই,
শিল্পীর তুলি পাখা মেলে দিয়েছে শূন্যেই,
কাগজেরা ফিরে গেছে বুনোবৃক্ষের ভেতরে সব,
অরণ্যে আজ পাখিদেরই বিজয় উৎসব।

নেই স্যাটেলাইট, বেতার, টিভি, ইথারের নেট
হঠাৎ উধাও হাওয়া-তুলোর সুতোয় বোনা রঙিন কার্পেট।

তুমি কিছু ঠিক করেছ ভেবে?
যে নদীর পেট অন্ধকারে ভরা
যাই ওখানে যদি আমি দেবে

এ-মুখখানি কোন আরশিতে পড়বে তখন ধরা?

১৭.
পাখি-হৃদয় মূলত খুব নিষ্ঠুর
অথচ এই পাখির জন্যে কত না দূর
ছুটে গেছি,
পায়ে পায়ে আলোর রেখা রোজ এঁকেছি।

পাখির কাছে
ধারালো এক চঞ্চু আছে,
ঠুকরে ঠুকরে ফুটো করে বৃক্ষ-হৃদয়

সুযোগ পেলেই পাখি দেখায় ডানার বিস্ময়।

১৮.
রেলগাড়ি নীল যাচ্ছে ঢুকে ঘন নীলের পেটে
বাইরে প্রহর রেলের সাথে যাচ্ছে হেঁটে হেঁটে।
নীল কুয়াশা হচ্ছে ঘন,
হচ্ছে গভীর অনেক দূরের অচেনা বন্ধনও।

পেছনে রোদ খুব ম্রিয়মান, পৃষ্ঠা থেকে যাচ্ছে মুছে দ্রুত
সব টানেলের শেষেই আলো এই কথাটি ভীষণ জনশ্রুত।

সেই আলোতে হাত বাড়ালাম আমি
অন্ধকারে আমি যে এক আজন্ম সংগ্রামী।

১৯.
পেড়ে খাবে সুপক্ক চাঁদ লোকটি গেল মাঠে।
চাঁদ সরে যায়,
এ-লোক তবু মই নিয়ে রোজ হাঁটে।

সুনীল গাছে ফল ধরেছে মেঘের পাখি খায়।
তৃষ্ণাকাতর চাতক পাখি
বৃষ্টি এলে দুয়েক ফোঁটা পায়।

প্রকাণ্ড এক মাঠের শেষে
জ্যোৎস্না-রাতে লোকটি থাকে আলোর অপেক্ষায়।

২০.
এখন তো সব রুক্ষ ধূসর,
পায়ের নিচে ভাঙছে পাতা, হচ্ছে পথের ধুলো,
মাটি থেকে অঙ্কুরিত মৃত্তিকাতেই শুলো।

আবার ধুলো তুলবে মাথা
নতুন বসন্তে
আলতো করে পা মাড়িও কালের এ-গ্রন্থে।

২১.
কোথাও বুঝি শব্দ হলো, বাজলো কিছু,
নাকি আমার প্রত্যাশিত ভ্রম?
ওই তো আবার,
যাচ্ছে কি কেউ অস্তগামী আলোর পিছু পিছু?

স্যাতস্যাতে জল-কাদার ওপর ছপাৎ ছপাৎ কার দু’কদম?

রাত্রি-শেষের অশ্বারোহী আনবে বুঝি আলো?
ওই তো আবার শব্দ হলো,
অন্ধকারে পদক্ষেপের সংখ্যা গুনি…

সংখ্যাগুলো হচ্ছে বড়ো, ভয়াল রাতের শব্দ শুনি।

২২.
গাছের পাতা
লাল হলো কী হলুদ হলো ঝড়ের বুঝি কিচ্ছু এসে যায়?
ঝাউবনে উৎসবের মাতম
আপেল বাগান শূন্যের অভিধায়।

ঝাউ-তরুণী সবুজ গাউন পরে দোলায় খুশির নিতম্ব
সুউচ্চ পাইন তুষার-ঝড়ে যুদ্ধ-জয়ের দেখাচ্ছে দম্ভ।

বার্চ কিশোরী,
ওক তরুণী
নগ্ন দেহ কোথায় লুকোবে?
আবার কবে বসন্ত-বাও ভালোবেসে উষ্ণ হাতে
ছাল-বাকল আর কাণ্ড ছোঁবে,
রোদের নিচে দীর্ঘ শীতের কষ্ট শুকোবে?

আসন্ন শীত দিচ্ছে আভাস সময় ভালো নয়
দেহ খুঁড়ে আগুন খোঁজো,
মুছে ফেলো অশুভ সংশয়।

২৩.
ঢেউয়েরা খুব ভাঁজ খুলে দেয়, দুলতে দুলতে আসে
আমি যখন ডুবি ওরা জলের ওপর ভাসে।

এই যে অযুত শিশির বাতি জ্বলছে ভোরের ঘাসে
যাচ্ছে গলে পথচারীর পায়ের সর্বনাশে।

ষাট, সত্তর কিংবা আশি
এক বিন্দু শিশির ছাড়া আর কি বলো?
অথচ এই বিন্দুটিকে এত্তো ভালোবাসি।

ঘাসের ওপর পড়ছে শুয়ে
মহাকালের পাদুকা সন্ত্রাসে
আমি যখন ডুবি ওরা জলের ওপর ভাসে।

২৪.
নিস্তব্ধতার নীল গহনে যাচ্ছি ডুবে, একা।
যাচ্ছে নিভে আস্তে-ধীরে প্রাচীন আলোর রেখা।

মহাকালের খরস্রোতা আসছে ধেয়ে, আসছে অথৈ জল,
চতুর্দিকে উঠেছে রব
অতিকায় এক ভয়ার্ত শোরগোল।

যাচ্ছি ভেসে, যাচ্ছি ডুবে,
যাচ্ছি আমি নতুন কোনো দেশে,
প্রলম্বিত উষ্ণ বাহু,
থাকবে তুমি ঠায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারের শেষে?

২৫.
সংখ্যাগুলো ছুটতে ছুটতে
যাচ্ছে নেমে
অন্ধকার এক গুহার ভেতর।
প্রকাণ্ড এই সবুজ মাঠের প্রান্তরেখায়
অন্ধকারের গুহা আছে
কে জেনেছে, বল?
সংখ্যারা সব ভগ্নাংশে যাচ্ছে নেমে…

স্বপ্ন-রোদের কাফেলাটি যাচ্ছে থেমে
মৃত্যু-গাছের-ছায়াতলে।

এর কবলে
পড়তে হবে কোনো একদিন,
মুখোমুখি দাঁড়াব যে
সে-তো আমার ছিল জানাই…

নিস্তব্ধতার আড়ালে আজ উঠছে বেজে
শেষ বিকেলের করুণ শানাই।