তিব্বতে বাঙালি পর্যটক ॥ মোহাম্মদ তৌহিদ


তিব্বতের দিনগুলো (পর্ব-৫)

পথ টেনে নেয় পথিককে। পথিকের পথচলা তাই কখনওই শেষ হয় না। পথিক আসে, পথিক যায়, পথ ও পদচিহ্ন থেকে যায় বহুদিন। তিব্বতের পথে পথে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা যুগ যুগ ধরে হেঁটে গেছেন। বেশিরভাগের ইতিহাসই খুঁজে পাওয়া যায় না এখন। তবে, যাদের পদযাত্রায় সমাজ ও জীবনে প্রভাব পড়ে, ইতিহাস তাদের কথা মনে রাখে। বাংলা অঞ্চলের এমনই একজন মানুষ ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর; যাকে তিব্বতিরা এখনও সম্মানের সঙ্গে মনে রেখেছে। তিব্বতের পথে পথে তিনি হেঁটেছেন, স্থানীয় বৌদ্ধধর্মের সংস্কারে রেখেছেন অসাধারণ ভূমিকা। আমি বাংলাদেশের মানুষ শুনেই তিব্বতের কয়েকজন প্রথমে অতীশ দীপঙ্করের নামটাই উচ্চারণ করেছে। কেউ একজন বোঝানোর চেষ্টা করল- ওই.ওইদিকে অতীশ দীপঙ্করের একটি মন্দিরও রয়েছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১০৩৮ সালে বাংলাদেশের বৌদ্ধপণ্ডিত, ধর্মগুরু ও দার্শনিক অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বতে যান। অতীশ দীপঙ্কর বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
তৎকালীন বৌদ্ধদের মধ্যে ধর্মের যথাযথ শিক্ষা প্রচার করা ছিল তাঁর লক্ষ্য। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ঘুরে তিনি অবশেষে তিব্বত যান এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। তাঁর তিব্বত-যাত্রা বঙ্গ অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্কের সেতু স্থাপন করে। অবশ্য, পরবর্তীকালে চীনের সঙ্গে বঙ্গ অঞ্চলের ব্যবসায়িক যোগাযোগের অনেক তথ্য পাওয়া যায়।

এরপর, ত্রয়োদশ শতকে চীনা বাণিজ্যতরী ও বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক ওয়াং তা ইউয়ানের বাংলা ভ্রমণের ইতিহাস জানা যায়। চতুর্দশ শতক থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত চীনের সঙ্গে বঙ্গ অঞ্চলের বন্ধুত্বপূর্ণ বিনিময়ে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অন্যতম চীনের মুসলিম নৌ-কমান্ডার চাং হ্য— যিনি অন্তত দু’বার জাহাজের বিরাট বহর নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছান। প্রাচীন ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ দুই অঞ্চলের মানুষকে এক সুতো দিয়ে মালার মতো গেঁথে রেখেছে। চীনের সঙ্গে বাংলা অঞ্চলের এ সম্পর্ক আড়াই হাজার বছরের পুরনো।

বলছিলাম জ্ঞানী অতীশ দীপঙ্করের গল্প। বৌদ্ধ পণ্ডিত, ধর্মগুরু ও দার্শনিক অতীশ দীপঙ্কর ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান ঢাকার বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে এক রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্যনাম ছিল চন্দ্রগর্ভ। দীপঙ্করের প্রাপ্তবয়সে তিব্বতের রাজা চ্যাং চুবের একান্ত অনুরোধে ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে কয়েকজন পণ্ডিতসহ দীপঙ্কর তিব্বত যাত্রা করেন। যাত্রা পথে বহু স্থানে এ দলটিকে সম্মাননা জানানো হয় বলে ইতিহাসের বইয়ে উল্লেখ আছে।

তিব্বতরাজ চ্যাং চুব অতীশ দীপঙ্করের তিব্বতে যাওয়ার পর দীপঙ্করকে তিব্বতের মহাচার্য ও ধর্মগুরু হিসেবে ঘোষণা করেন।

জানা গেছে, তিব্বতে থো-লিং বিহার ছিল অতীশ দীপঙ্করের মূল ধর্মচর্চা কেন্দ্র। এ বিহারে তিনি অনেকটা দেবতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এখান থেকেই তিনি তিব্বতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম থেকে ব্যভিচার দূর হয় এবং উন্নত বৌদ্ধ ধর্মচর্চা শুরু হয়। বর্তমান তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাঁকে গৌতম বুদ্ধের পর শ্রেষ্ঠ ধর্মগুরু হিসেবে সম্মান ও পূজা করে থাকে।

তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মীয় উপাসনালয়ে ইতিহাসের এমন নানা তথ্য লিপিবদ্ধ করা আছে।

চলার পথে এ কার হাতছানি! তিব্বতে দারিদ্র্যমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি নিয়েছিল স্থানীয় সরকার। তার একটি হলো- স্থানান্তর প্রকল্প। অর্থাৎ, দুর্গম ও চাষবাস অযোগ্য জায়গা থেকে অপেক্ষাকৃত বসবাস-যাতায়াত-কাজের জন্য উপযুক্ত স্থানে স্থানীয়দের স্থানান্তর করার মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্তির চেষ্টা করা। গণচীনের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানেও সেই প্রকল্প সফল হয়েছে।এরকম অসংখ্য গ্রামের মধ্যে একটি গ্রাম প্রথমেই পরিদর্শন করা হয়। গ্রামটির নাম শিকাহ্। তবে শিকাহ্‌কে আপাতত শিকেয় তুলে রাখি। কারণ, চলার পথে ভয়ঙ্কর এক সৌন্দর্যের অবিরাম হাতছানি আমাদের অবশ করে দিচ্ছে বারবার।

সে আমাদের অতি আপন, অতি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ বা ইয়ালুং চাং পো। কিন্তু বাংলাদেশের নদের সঙ্গে এই উৎসভূমির কোনো তুলনা করারই সুযোগ নেই। চীনের তিব্বত থেকে ভারত ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা পার হয়ে বাংলাদেশে গিয়ে পড়েছে এটি। ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি হিমালয়ের শিমায়াঙ-দাঙ হিমবাহ থেকে। পর্বত ঘেরা অঞ্চলে যে ব্রহ্মপুত্র দেখা যাচ্ছে, চিরচেনা বাংলার সেই নদের সঙ্গে এর কোনো মিলই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

আসলে ভাটি অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র আর বরফগলা পানিতে সৃষ্ট স্বচ্ছ ব্রহ্মপুত্রের উৎসভূমির এক রূপ হতে পারে না। হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ নদীর বিভিন্ন অংশের রূপ-সৌন্দর্য বৈচিত্র্যময় হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

আকাশের নীল আর পর্বতের সবুজ গাছপালার প্রভাবে নদের পানি মিশ্র সবুজ-নীলাভ রং ধারণ করেছে। প্রচণ্ড উত্তাল অথচ ভীষণ গম্ভীর তার রূপ দেখা যাচ্ছে। নদীটি যেন দু’পাশের পর্বতকে দু’হাত দিয়ে উঁচু করে ধরে রেখেছে! প্রকৃতির অদ্ভুত এ সৌন্দর্য আবিষ্ট করে রেখেছিল আমাদের। চলার পথে কমপক্ষে ১০ কিলোমিটার জুড়ে ব্রহ্মপুত্র নদ আমাদের সঙ্গে ছুটে চলল। স্বচ্ছ টলটলে জলধারা বাংলাদেশে অমন ভিন্ন রং ধারণ করেছে ভাবতেই বিষণ্ণতা চেপে ধরল। এই বিশাল নদী অববাহিকার আয়তন ৫,৮৩,০০০ বর্গকিলোমিটার; যার ৪৭,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার অবস্থান বাংলাদেশে। বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রের প্রধান চারটি উপনদীর নাম দুধকুমার, ধরলা, তিস্তা এবং করতোয়া-আত্রাই প্রণালী।

শিকাহ্ গ্রাম
বিমানবন্দর থেকে গাড়িবহর তখনও চলছে। নয়নাভিরাম প্রকৃতির মাঝ দিয়ে, কখনও ব্রহ্মপুত্রের উপর দিয়ে, কখনওবা তার পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়িবহর। গন্তব্য শিকাহ্ গ্রাম। তিব্বতের পার্বত্য অঞ্চলের স্থানান্তরিত একটি গ্রামের মানুষের নতুন জীবন দেখানো হবে। গ্রামটিতে মোমবাহ্ জাতির ৭২টি পরিবারের দেড় শতাধিক মানুষ বাস করছে। গাইড জানালো, ২০০৩ সালে গ্রামটি তৈরি করা হয়েছিল। এরপর আশেপাশের মানুষদের দুর্গম অঞ্চল থেকে নিয়ে এসে এখানে বাসস্থান ও কর্মক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া হয়।

প্রথম দর্শনে এটি সাধারণ একটি গ্রাম। ছিমছাম, শান্ত নিরিবিলি এলাকা। সাজানো-গোছানো পথঘাট ও বাড়ি-ঘর। তবে, বসতবাড়ির দেয়াল, বাড়ির চৌকাঠ, ঘরের চালায় তিব্বতি ধাঁচের রঙের ছড়াছড়ি চোখে পড়ার মতো। পর্যটক আকর্ষণেই হয়তো এমন রঙের ব্যবহার সেখানে। আসলে যেখানে প্রকৃতি নিজেই ভীষণ রঙিন, সেখানে প্রকৃতির পরম যত্নে লালিত এসব জাতির মাঝেও রঙের ব্যবহার থাকবে- সেটাই হয়তো স্বাভাবিক।

অতিথি আসবে শুনে গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সেজেছিল। অতিথিদের গ্রাম ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য কমপক্ষে ১০জন ‘টুরিস্ট গাইডও’ প্রস্তুত ছিল। তারা এ গ্রামেরই বাসিন্দা।এবং এটি একটি পর্যটন গ্রাম।

চীন সরকারের উদ্যোগে সারা চীনে কয়েক হাজার ‘পর্যটন গ্রাম’ গড়ে তোলা হয়েছে, গ্রামীণ পর্যটনকে চাঙ্গা করা হয়েছে। এতে করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বাড়তি আয়ের পথ খুলে গেছে। সেই সঙ্গে আধুনিক সুযোগ সুবিধায় বেড়ে ওঠা শহুরে লোকজন- বিশেষত তরুণ সমাজ গ্রামের সহজ-সরল পরিবেশে আসার সুযোগ পেয়েছে। তারা সামাজিক জীবনের মৌলিক অংশটির সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছেন। গ্রামীণ জীবন মানেই সেখানে রয়েছে কৃষিকাজ, পশু-পাখি লালন-পালন, শাক-সবজি-ফলমূল চাষ ইত্যাদি। তবে, তিব্বতের এই গ্রামটিতে যুক্ত হয়েছে বাড়তি কিছু; যেমন- পর্যটন। প্রতি মাসেই শিকাহ্‌ গ্রামে চীনা ও বিদেশি পর্যটকরা আসছেন। তারা ঘুরছেন, দেখছেন, কেনাকাটা করছেন। হ্যাঁ, গ্রামের মানুষ পর্যটকদের কাছে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী পণ্য তুলে ধরছেন।

বেশিরভাগই বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কিত স্থানীয় বিভিন্ন সামগ্রী। যেমন- কয়েক ধরনের আগরবাতি/ধূপকাঠি, হাতে তৈরি কাপড়, রুমাল, ধর্মীয় শ্লোক লেখা দেয়ালচিত্র (ওয়ালম্যাট), রঙিন পুতুল ও খেলনা, হাতে তৈরি কাগজ, পাহাড়-পর্বতে চাষ করা বিভিন্ন মশলা।

গ্রামে নেমেই চোখে পড়েছিল চারদিকের সুউচ্চ পর্বতসারি। মেঘ ফুঁড়ে বেড়ে উঠেছে সেসব। সাদা সাদা মেঘে সামনে আগানোর পথ না পেয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ি দেয়ালে ঠেস দিয়ে! বোধ হয় ভাবছে, এখন কী করা! হুরমুড়িয়ে সেসব ছবি তুলছে পর্যটকরা। এসব পর্বতের বুকে চাষ হয় বিভিন্ন ধরনের মশলা ও ওষধি গাছ। গ্রামটির অন্যতম আয়ের উৎসও এটি। গ্রামের মধ্যে ছোট-খাটো একটি জাদুঘর ও হরেক দোকান আছে। শ’দেড়েক লোক বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে ঘুরে বেড়াল, দেখল, কিনল। কিছু মশলা বেশ পরিচিত। যেমন- দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ। বাকিগুলোর চীনা নাম- মনে রাখা কষ্টসাধ্য। কিছু ওষধি গাছের কাঠের ছোট ছোট টুকরা রয়েছে। তা ঘরের মধ্যে রাখলে সুগন্ধ হবে, পোকামাকড় আসবে না, রোগবালাইও দূর হবে- এমন বলা হলো। এর মধ্যে একটি কাঠ সবার পরিচিত; স্যান্ডালউড বা চন্দন কাঠ। বড় বড় কাঁচের পাত্রের ভারী ভারী ঢাকা সুগন্ধি কাঠের টুকরা। যাত্রাপথের ক্লান্তি অনেকটাই দূর হয়ে গিয়েছিল দশ রকমের কাষ্ঠল-ঘ্রাণে। তিব্বতিরা হয়তো মুচকি হেসেছিল বাঙ্গালি-বিদেশির কাণ্ড দেখে।

যাই হোক, জাদুঘরের দুটি সৃষ্টিকর্ম আমার নজর কাড়ে। একটি হলো আগরবাতি বা ধূপকাঠি তৈরির প্রক্রিয়া। পুরোটাই তারা নিজেরা করে। শত শত ট্রেতে লাখ লাখ পিস আগরবাতি রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। আরেকটি চমৎকার জিনিস হলো প্রাচীন পদ্ধতিতে হাতে তৈরি কাগজ। খানিকটা মোটা, খসখসে। কাগজের মণ্ড তৈরি করে জালি ট্রেতে বিছিয়ে কয়েকদিন রাখলে একটি স্তর জমে যায়। তারপর সেই ট্রে কয়েকদিন রোদে শুকালে বড় বড় আর্ট পেপার উঠে আসে। রংটা দুধের সরের মতো, কাগজটাও কিঞ্চিত খসখসে শক্ত হয়। তবে কাগজই বটে। শত শত বছর আগের মতো হাতে তৈরি করা সেই কাগজ! চীনাদের চারটি প্রধান আবিষ্কারের মধ্য অন্যতম এই কাগজ। যা নিয়ে সবসময় গর্ব করতে পারবে চীনা জাতি।