প্রত্যাবর্তন ॥ মো. রেজাউল করিম


বাপের কথা জবার মনে পড়ে অস্পষ্ট, রাতে দেখা স্বপ্ন যেমন সকালে কিছুটা মনে পড়ে, আবার পরক্ষণেই মানস থেকে দ্রুত সরে যায়- তেমনি। গত বছর মা-ও চলে গেল পেটের ব্যথা নিয়ে। প্রথমে গ্রাম ডাক্তারের কাছে গেলে ব্যথা কমার ওষুধ দেয়। দিনে দিনে ব্যথার তীব্রতা বাড়তে থাকে, খাওয়া-দাওয়া আস্তে আস্তে বন্ধ হতে থাকে, একসময় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। জবার চাচা কবিরাজ ডেকে আনে, তিনি শহরের হাসপাতালে নিতে বলেন, হাসপাতালে কে নিয়ে যাবে, চিকিৎসা খরচই-বা কে দিবে; এক সকালে জবার হাউমাউ শুনে চাচা, চাচি, তাদের ছেলে-মেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে জানতে পারে জবাকে একা রেখে তার মা-ও পরপারে পাড়ি দিয়েছেন।

সেই থেকে কিশোরী জবার জীবন চলে চাচা আবদুল জব্বারের বাড়িতে কাজের বুয়ার মতো। একই উঠোনে গোটা তিনেক ঘর। ওর চাচার ঘর দুটো টিনের, জবার ঘর মাটির, খড়ের চাল। মায়ের সাথে থাকতে কোনোদিন ভয় করেনি, এখন একা এই ভাঙাচোরা ঘরে থাকতে রাতের বেলা ভয় করে। দূরে অনেক শেয়াল গলা চড়িয়ে সমস্বরে হুক্কাহুয়া রব তুলে, কিংবা ঘরের পাশ দিয়ে যখন বেজি কিংবা বাঘডাশ সরসর শব্দ তুলে চলে যায় তখন জবা নিঃশ্বাস বন্ধ করে পা গুটিয়ে বুকের কাছে এনে মরা মানুষের মতো নিঃসাড় পড়ে থাকে। কোনও কোনও দিন নিজের অসহায়ত্বের কথা স্মরণ করে ঘরের ওপরের আড়ার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে। ভোর থেকে কাজ শুরু করতে হয়, রান্না বাদে সবকিছুই- উঠোন ঝাড় দেওয়া, কুয়ো থেকে দফায় দফায় পানি তোলা, কাপড় কাচা, গরুর বিচালি কাটা কত কাজই না থাকে গ্রামের বাড়িতে। চাচা বাড়িতে না থাকলে মোড়ের দোকান থেকে টুকটাক সদাইপাতিও কিনতে যেতে হয়। কয়েকদিন হলো দোকানের কাছে বসে থাকা আলাল আর হিরু এটা-সেটা বলে তাকে; পনের বছর বয়সী জবার সেসব কথার অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয় না। জবা চাচির কাছে নালিশ দেয়। একদিন, দুইদিন, তিনদিন শোনার পরচাচি স্বামীকে জানায়। আবদুল জব্বার আলাল ও হিরুকে দুকথা শুনিয়ে আসে আর ওকে দোকানে যেতে না করে, এরপরে শুরু হলো নতুন উপদ্রব- গভীর রাতে ঘরে কাঠের জানালায় টোকা দেওয়া কিংবা ঘরের চালে ঢিল ছোঁড়া। জবা চাচিকে এগুলো জানালে তিনি রেগে গিয়ে বলেন, ‘বাপ মরেছে, মা মরেছে, এখুন তুই মইরি আমাগেরে শান্তি দে দিনি। তোর জন্নি কি গাঁয়ের শয়তান ছাওয়াল-পাওয়ালের সাথে গোণ্ডগোল করতি যাব? আমার ছাওয়ালেক মাইরি থুইলি ঠ্যাকাবিন কিডা?”

উদয়াস্ত কাজ শেষে সাঁঝের আঁধার নামলেই জবার ঘুম আসে। কিন্তু বাড়ির সকলে না খাওয়া পর্যন্ত তার ঘুমানোর সুযোগ নাই। এর মাঝে বিকেলে যখন বাড়ির সকলে বিশ্রাম নেয় সে তখন ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নেয়। সেদিন রাতে সকলের খাওয়া-দাওয়া শেষে জবা যখন ঘুমের সুযোগ পেল তখন বাড়ির সামনে সরু পায়ে চলা পথে মানুষের পদশব্দ বন্ধ হয়েছে, ঝিঁঝি পোকার অবিশ্রান্ত ডাক শুরু হয়েছে, মাঝে মাঝে রাতজাগা পেঁচার ডাকও দ্রুতই শুরু হয়।

আলাল ও হারু তখন জবাদের উঠোনের দক্ষিণে টিনের পায়খানার পেছনে বসা। ঝোপ-ঝাড় সরিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে আসা কাস্তে দিয়ে ছোট ছোট গাছগুলো কেটে ফেলে। দুটো গামছা পাশাপাশি বিছিয়ে দুজন বসে পড়ে। মশার যন্ত্রণা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। হাত নাড়িয়ে মশা তাড়ানো ছাড়া কিছুই করার নেই। মশা মারতে গেলে শব্দ হতে পারে, তাতে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। অস্থিরতা কমানোর জন্য হারু বিড়ি ধরাতে গেলে আলাল তাকে নিবৃত্ত করে। দূর থেকে কেউ আগুন দেখে ফেলতে পারে। আধা ঘণ্টা সময় অথচ মনে হয় ওরা সন্ধ্যা থেকেই বুঝি-বা এখানে বসে আছে। তা-ই হয়। সুসময়গুলো দ্রুত নিঃশেষ হয় আর দুঃসময় দীর্ঘতর মনে হয়।

ভাত খেয়ে ভরপেটে পানি খেয়ে জবা ঘুম আর ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। দু’চোখ ছাপিয়ে ঘুম আসে বিপুলা পাথরের মতো- সে সময়ে জবা নিমিষেই অচেতন। রাত বারটার পরে তলপেট ভারি হয়ে আসে, জবার ঘুম ভেঙে যায়। অভ্যেস মতো দরজার ফুটো দিয়ে দুই পাল্লার মাঝের সামান্য ফাঁক দিয়ে ঘরের বাইরে উঠোনটা দেখে নেয়। না- কেউ নেই। প্রায় নিঃশব্দে দরজার পাল্লা খুলে আবারও উঠোনে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়, না- কেউ নেই। হেরিকেনটা হাতে নিয়ে পায়খানাতে ঢুকে, পেট খালি করে দরজায় যেন শব্দ না হয় এমনভাবেই খুব ধীরে টিনের পাল্লাটা খুলে পায়খানার বাইরে মাটিতে পা রাখে। অমনি কে একজন পেছন থেকে তার কোমর জড়িয়ে ধরে। চিৎকার দেওয়ার আগেই আরও একজন কাপড় জাতীয় কিছু দিয়ে তার মুখটা বেঁধে ফেলে। ধস্তাধস্তি চলতে থাকে- একদিকে গামছা ও রশি নিয়ে ষন্ডামার্কা দুই যুবক, অপরদিকে খালি হাতে শীর্ণকায়া এক কিশোরী। আলাল ও হারু রশি দিয়ে তার পা-জোড়া বেঁধে ফেলে, মুখের গামছা আরও ভাল করে বেঁধে, এবারে কাঁধে করে দুজন গ্রামের গোরস্থানের পাশে নিয়ে যায়, পায়ের বাঁধন খুলে ওরা দুজনে পর্যায়ক্রমে কাম চরিতার্থ করে, প্রথমে আলাল পরে হারু। আলাল আবারও প্রস্তুতি নিলে হারু তাকে যে কথা বলে তাতে সে অবদমিত হয়ে যায়। হারু বলে, ‘এই হালা ওর মুখে যে বাঁধন দিছিস, ও-তো বোধ হয় মইরি গিইছে। আমাক্ তুই মরা মানুষ দিলি হালার পো হালা।’

‘গাইল পারিস নিতো, আগে ভালো কইরি দেইখি নি। তারপরে তোক্ কবো, বাঁইচি তো থাকতিও পারে।”আলাল গামছার বাঁধন আলগা করে নাকের ওপরে দীর্ঘক্ষণ হাত দিয়ে রাখে, না কোনো শ্বাস আসে না। বামের শীর্ণ স্তনের ওপরে জোরে কান চেপে ধরে- না বুকের ধুকপুক আওয়াজও কানে আসে না।আলাল বলে, “হারু, ওর চাচা তো কয়দিন আগে আমাগেরে শাসায়্যে গিইছে। পুলিশ মরা মানুষ পালি পারে, আমাগেরেই ধরবিনি। চল পলা যাই। আর লাশটাকে গোরস্থানের কোনও কব্বরের মদ্যি ফ্যালায় আসি।”ওরা দুজন জবার কাপড় হাতে নিয়ে ধরাধরি করে জবাকে টানতে টানতে গোরস্থানে ঢুকে। কয়েকটা কবর পার হতেই ঈষৎ চন্দ্রালোকে একটা গর্তকবর পেয়ে যায়। গর্তের মধ্যে জবাকে শুইয়ে দেয়। কাপড়গুলো দিয়ে ওর শরীর ঢেকে কাস্তে দিয়ে আশেপাশের কিছু ঝোপঝাড় কেটে এনে জবার লাশের ওপরে দিয়ে দেয়। সাথে কোনও টাকা-পয়সা নাই। পালাতে হলে টাকা-পয়সা লাগে। নেশার বন্ধু সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। নেশাখোররা সময়ে বিবাদ-বিসম্বাদ করলে অনায়াসে একজন অন্যজনের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। আবার একজন বিপদে পড়লে তাকে বাঁচানোর জন্য চূড়ান্ত ঝুঁকি নিতে কাপর্ণ্য করে না। আলাল ও হারু তাদের নেশার বন্ধু জামালের বাড়ির দিকে রওনা হয়। জামালের বাড়িতে পৌঁছে ওর ঘরের পেছনের জানালায় টোকা দেয় বেশ কয়েকবার। নাহ্ সেই সন্ধ্যায় হিরোইন টেনেজামাল বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মোবাইল ফোনে বারবার কল দেয় তাও ওর ঘুম ভাঙে না, ভোর হয়ে যায় কিনা এই দুশ্চিন্তায় ওরা ততক্ষণে ঘেমে নেয়ে উঠেছে। এর মধ্যে একটা কুকুর ওদেরকে দেখে তারস্বরে ঘেউ ঘেউ করে চলে। কুকুরের ডাকে কিংবা মোবাইল রিঙটোনে জামালের ঘুম ভাঙে। যুদ্ধ করেই চোখের পাতা ঈষৎ ফাঁক করে, আলালের নাম দেখে কথা বলে, “কি-রে কী হয়ছে, এত রাইতে ফোন করিছিস ক্যা?”
“আবে রাইত আর বেশি নিই-রে, পিরাই সকাল, দরজা খোল্ কথা আছে।”

জামালের ঘরের পেছন দিকে কোনো দরজা নাই, তবে জানালা আছে। জানালা খুলে জিজ্ঞেস করে, “কি-রে, ঘোমের টাইমে তুরা দুইজন ঘরের বাইরে কী করিস, কী কামে ঘোমের তে ডাইকি তুললি তাই ক।” আলালও সচকিত হয়ে ওঠে। সে ঘটনা বলে না। শুধু বলল, “একখেন ঘটনা ঘটাইছি, পলাতি হবি। বাড়িত যাতি হোলিদেরি হয়ি যাবিনি। কিছু ট্যাকা দে, দিয়ি দেবোনে, সুমায় নষ্ট করিসনে যা আছে তাই দে।” জামালের বাপ সম্পন্ন গৃহস্থ। জামালই বেশিরভাগ সময় এদেরকে ফেনসিডিল কিনে খাওয়ায়। বিনিময়ে ওরা ঝুঁকি নিয়ে শহর থেকে ফেনসিডিল কিনে আনে। মাস্তি করার জন্য শহরে নতুন নতুন জায়গা খুঁজে বের করা, তাও ওরাই করে। জামাল বুঝে নেয় ওরা নিশ্চয় বড়ো ধরনের কোনও অঘটন ঘটিয়েছে, তা-না হলে এত রাতে নিজ নিজ বাড়িতে না গিয়ে পালাতে চাচ্ছে কেন? জামাল ওদেরকে বিদায় করার জন্য দেরি না করে টেবিলের ড্রয়ার, জামার পকেট হাতড়ে একশ টাকার পাঁচখানা নোট এনে ওদের হাতে দিয়ে বলল, “যা করিছিস করিছিস, আমার বাড়িত-তি সইরি পড়। পরে ফোনে কইস কী করিছিস।” গ্রাম থেকে যে রাস্তাটা বড়ো রাস্তার দিকে গিয়েছে, টাকা নিয়ে আলাল ও হারু সেই রাস্তায় না গিয়ে গাঁয়ের পেছন দিকের রাস্তা ধরে, সটো উত্তর না দক্ষিণ তা তাদের জ্ঞানে আসে না। রাত্রি জাগরণ, জবার সাথে ধস্তাধস্তি, জবাকে কাঁধে করে ওদের বাড়ি থেকে কবরস্থান পর্যন্ত আনা- সব মিলিয়ে ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সন্ধ্যায় জামালের সাথে আজ ফেনসিডিল না খেয়ে হিরোইন খেয়েছে, তাই এতক্ষণও জেগে, নয়তো মানুষ খুন করেও হয়ত কোথাও ঘুমিয়েই পড়ত। হিরোইনের নেশায় এতকিছু চিন্তাও করেনি, জবা যে মরে যাবে তাতো বুঝতেও পারেনি। আসলে হিরোইন খাওয়ার পরে জবাকে পাওয়ার নেশাটাই শুধু মাথাতে কাজ করেছে, আগে-পিছে কী হবে বা হতে পারে তা চিন্তা করেনি বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ততটুকু বোধশক্তি ছিলও না। গাঁয়ের এ-দিককার বাজারে ওরা সচারচর আসে না।

যে কারণে সাতসকালে যে দু’-একজন মানুষ ঘোরাফিরা করছে তারা ওদেরকে চিনতে না পারারই কথা। বাজারের পাশে মসজিদে প্রাতঃক্রিয়া সেরে নেয় দুজন। জানামতে এখানে ভাত-রুটির একটা ছাপরা দোকান রয়েছে, কিন্তু সেটা এখনও খোলেনি। একটা নসিমন দেখা মাত্র দেরি না করে সেটাতে উঠে পড়ে, কিছুক্ষণ চলার পরে বড়ো রাস্তা দেখতে পায়, সেখানে নেমে বাস ধরে- তাদের আপাত গন্তব্য রেলস্টেশন। ট্রেনের ছাদে চড়ে ঢাকায় যেতে হবে। টাকা খরচ হবে না, কেউ দেখবেও না। ঢাকায় যখন পৌঁছায় তখন রাত। অন্ধকারই ওরা চায়। নষ্ট মানুষ অন্ধকার পছন্দ করে, অন্ধকারে নষ্টামি করা সহজ, অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা কিংবা পালিয়ে যাওয়া সহজ। এই চরাচরে যত নষ্টামি হয়, তার বেশির ভাগ রাতের অন্ধকারে হয়। আসার পথে অজানা এক স্টেশনে নেমে বনরুটি ও কলা কিনে আবারও ছাদে চড়ে বসেছে। ওরা ভেবেছিল রেলের ছাদে মুফতে যাওয়া-আসা করা যায়। না, তা-না। ওখানে বসে যারা যায়, তাদের থেকেও পয়সা আদায় করার লোক আছে, তবে যা দিতে হয় তা সামান্যই। সারাদিনে দুটো বনরুটি আর কলা ছাড়া পেটে কিছু পড়েনি, পেট করছে চোঁ চোঁ। স্টেশনের সামনে ফুটপাতে ডিমের ঝোল আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে স্টেশনের আশেপাশে ছিন্নমূল মানুষের মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে কাঁচপুর ব্রিজে পৌঁছে যায়।


কবরস্থানের পাশের ছোট্ট মসজিদের মুয়াজ্জিন আবুল হাশিম সুবহে সাদিকের সময়ই মসজিদে আসেন। তখনও মসজিদে কেউ আসেনি। টিউবয়েল চেপে প্লাস্টিকের বদনায় পানি ভরে অযু করেন। আবুল হাশিম গ্রামেরই বয়স্ক মানুষ, পেশাদার নন; বয়সজনিত কারণে কাজকর্ম করতে পারেন না বলে তাকে মুয়াজ্জিন হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কণ্ঠস্বর সুললিত নয় তবে গভীর মনোযোগে মন ও আত্মার সম্মিলনে টেনেটেনে আজান দেন। আজান যখন শেষ, সুবহে সাদিকের রেশ ততক্ষণে অর্ন্তলীন। সূর্যের আলো নয়, অবর্ণনীয়-অপার্থিব এক আভা তখন চরাচরের অন্ধকার দূর করে স্বর্গীয় এক পরিবেশ তৈরিতে রত। নানা ধরনের পাখি প্রাতঃকালীন বিরামহীন কিচিরমিচিরে ব্যস্ত। মসজিদ লাগোয়া কবরস্থানের অস্বাভাবিকতা তাঁর চোখ এড়ায় না। তিন-চারটে স্বাস্থ্যবান শিয়াল নির্দিষ্ট একটি কবরে ওঠা-নামা করছে, খুব ব্যস্ত ওরা- তবে যা করছে তা তাদের স্বভাব অনুযায়ী নিঃশব্দেই করছে। ততক্ষণে মসজিদে আরও দুজন মুসল্লি এসে পৌঁছেছেন। আবুল হাশিম হাতে একটা লাঠি নিয়ে দূর থেকে শিয়ালগুলোকে উদ্দেশ্য করে হুশ হুশ শব্দে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেন। শিয়াল সামান্য আলোতেও মানুষকে এড়িয়ে চলে। মানুষের হাতে লাঠি থাকলে তো কালবিলম্ব করে না। আজ ওরা লাঠি হাতে আবুল হাশিমের মুখনিঃসৃত শব্দে বোকার মতো তাকায় কিন্তু পালায় না। কবরের গর্তের ওপরে থমকে দাঁড়িয়ে ওরা, যেন মনে মনে বলছে- তোমাকে তো বাপু জ্বালাচ্ছি না, কামড়ও দিচ্ছি না- আমাদের কেন তাড়িয়ে দিত চাও?

আবুল হাশিম আরও দুজন মুসল্লিকে লাঠি নিতে বলে, তিনজন লাঠি হাতে এগিয়ে যায়, শিয়ালগুলো তিনজন লাঠিধারী মানুষ দেখে প্রচণ্ড অনীহা নিয়ে ধীরে ধীরে কিছুটা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে; নিশ্চিত খাবার হাতছাড়া হয়ে যায় কিনা এই দুঃশ্চিন্তায় তখনও ওদের চোখ ঠিকরে বিদ্যুৎ ঝলক দিচ্ছে। আবুল হাশিমসহ তিনজন কবরটার কাছে গিয়ে ইন্নালিল্লাহ শব্দে পিছিয়ে আসে। ততক্ষণে যেসব মুসল্লি ফজরের নামাজ জামাতে পড়ার জন্য আসেন তারা সকলেই এসেছেন। কথাটা মুহূর্তে চাউর হয়ে যায়- পুরনো এক কবরের মধ্যে একটা মেয়ের লাশ; শিয়াল ইতোমধ্যে লাশটা ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে, মুয়াজ্জিন সাহেব জানালেন- ওটা অনেক পুরনো কবর, সম্প্রতি ওখানে কাউকে দাফন করা হয়নি। তাহলে লাশ এলো কোথা থেকে? ওদিকে ফজরের ওয়াক্ত যায় যায়, সকলে একসাথে নামাজে দাঁড়ালে শিয়ালগুলো লাশটা আরও ক্ষতবিক্ষত করবে, পুরোটাই খেয়ে নিতে পারে। সিদ্ধান্ত হলো দুজন মুসল্লি লাঠি হাতে পাহারায় থাকবে, অন্যান্যেরা দ্রুত নামাজ আদায় করে নিবেন, জামাত-শেষে ঐ দুজন নামাজ আদায় করে নিবেন। কিছুক্ষণের মধ্যে খবরটা গোটা গাঁয়ে চাউর হয়ে গেল। চেয়ারম্যান সাহেব চৌকিদারকে ফোন করে দ্রুত ঘটনাস্থলে যেতে বললেন। গাঁয়ে হৈচৈ, দৌড়াদৌড়ির শব্দে জবার চাচা-চাচির আজ সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের বাইরে এসে জবার ঘরের দরজা খোলা দেখে ঘরে গিয়ে দেখে জবা নেই। আবদুল জব্বার আজ কিছুটা তাড়াতাড়িই হাত-মুখ ধুয়ে বাড়ির বাইরে এসে জানতে পারলেন গাঁয়ের কবরস্থানে একটা মেয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছে। তিনি ভেতরবাড়িতে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে বউকে কথাটা বলে লুঙ্গির একটা কোণা উঁচু করে ধরে কবরস্থানের দিকে ঊর্ধশ্বাসে দৌড় দেন। সেখানে গিয়ে ভাতিজির ক্ষত-বিক্ষত, রক্তমাখা লাশ দেখে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যান। পুলিশ আসে- ময়নাতদন্তের জন্য লাশ নিয়ে যায় শহরে। সূর্য মাথার ওপরে ওঠার আগেই গ্রামবাসী জেনে যায় একাজ করেছে আলাল ও হারু।


আলাল ও হারু ততক্ষণে পগারপার।কমলাপুর থেকে হেঁটে শীতলক্ষা নদীর ধারে কাঁচপুর সেতুর পাথর কোয়ারিতে দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে কাজ পায়- জাহাজ থেকে পাথর নামানোর হিসাব রাখা। ঠিকাদার সম্ভবত ওদেরকে প্যান্ট-শার্ট পরে থাকতে দেখে এবং বিদ্যার দৌড় স্কুুল পর্যন্ত জেনে শ্রমিক হিসেবে না নিয়ে শ্রমিকদের কাজের হিসাব রাখতে নিয়োজিত করে। বিকেলে মজুরি পেয়েই কমলাপুরে চলে যায়, ফুটপাত থেকে লুঙ্গি-গামছা কিনে, রাতে নলা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে ক্লান্ত শরীরে ঘুমুতে যায়, বয়োপ্রাপ্তির পরে তো আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়েছে, আজ সারাদিন কাজ তারপরে আসা-যাওয়ার ঝক্কি, সব মিলিয়ে রাজ্যের ক্লান্তি ওদের ওপরে ভর করে। কয়েকদিন কাজ করার পরে ওরা কাঁচপুরেই শ্রমিকদের মেসে একটা ঘর ভাড়া করে- এভাবেই চলতে থাকে, ভুলেও কখনও ওরা বাড়িতে ফোন করে না। এটুকু ওদের জানা আছে- ফোন করলেই পুলিশ জেনে যাবে ওরা কোথায় আছে। এখানে নেশা করতে পারে না- ঠিকাদার জেনে গেলে কাজ থেকে বাদ দিয়ে দিবে এই আশঙ্কায়। বাড়ির সাথে কোনও যোগাযোগ নাই, গ্রামের ছেলে শহরের পাথরের স্তূপে হাঁপিয়ে ওঠে। চৈত মাসের ঠাঠা রোদে যেদিকেই তাকানো যায়, ঝাঁঝাঁ মরীচিকা। ওপর থেকে চোখ নামিয়ে আশেপাশে তাকালে চোখে পড়ে কতগুলো যন্ত্রমানব- মাথায় পাথর বোঝাই ঝুড়ি নিয়ে দুই হাতে ঝুড়ি ধরে নিঃশব্দে জাহাজ থেকে সরু কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে নেমে আসছে, ওদের বুক তখন একবিঘৎ উঁচু, মুখটা হা, পাথরের ঝুড়ি খালি করা মাত্রই ওদের বুক ওঠানামা করে হাপরের মতো। শব্দহীন মানুষগুলোর মনে বেজে চলেছে তখন ঝুড়ি থেকে পাথর ফেলার শব্দ ‘ঝপাস’ ছাড়িয়ে স্ত্রী-সন্তানের দুুমুঠো খাবারের জন্য নৈঃশব্দময় হাহাকার।

এই হাহাকার, কান্না পৃথিবীজুড়েই চলছে হাজার বছর ধরে। তপ্ত রোদে ছাতা মাথায় আলাল দাঁড়িয়ে ভাবে ঘটনা যা ঘটেছে, এরপরে আর কি কোনও দিন বাড়ি যাওয়া যাবে? আর কি কোনও দিন বাপ-মাকে দেখতে পাবে? এখন নেশা করে না- বুঝতে পারে নেশা না করলে সেই অন্ধকার রাতে কবরস্থানের পাশে কোনও মানুষের পক্ষে ঐ কাজ করা সম্ভব না। প্রায়ই মনে হয় এমন কোনও অলৌকিক ঘটনা কি ঘটা সম্ভব যার কারণে সে আবারও গ্রামে ফিরে যেতে পারবে? তার বুকের মধ্যে বোবা কান্না মোচড় দিয়ে ওঠে। কোনও কোনও রাতে এসব বিষয় নিয়ে হারুর সাথে কথা বলে। হারু রাজি হয় না গ্রামে যেতে। আলাল নানা বিকল্প তার কাছে তুলে ধরে। টাকা দিয়ে জবার চাচার সাথে মীমাংসা করার কথাও বলে। হারু জানিয়ে দেয় তার বাবা লাখ তো দুরের কথা হাজার টাকা দেওয়ার সামর্থ্য রাখে না। আলাল বলে “আচ্ছা জেলে গেলি কী হবি? আমরা তো জেলেই আছি। জেলে গেলি পরে তাও বাপ-মা দেখতি আসবি, তাদের সাথে দেখাও হবি।”
“হয়, তারপরে কী হবি? কোর্টে ফাঁসি দিলি পরে আমার বাপ ঢাকায় মামলা করতি যাতি পারবিনানে। তোর বাপেও কী পারবিনি? পারবি না। তখুন তো ফাঁসিই হবি। তার তি এইখিনি তো বাঁইচি আছি। একদিন ঢাকাত্ বিয়ে-থা কইরি ছাওয়াল-পাওয়াল নিয়ি জীবনডা এইখিনিই পার কইরি দেবোনে।”
“হারু, ইক কি বাঁইচি থাকা কয়?”
“তুই কি রাজার হালে বাঁইচি থাকতি চাইস-রে? শোন কমলাপুরে দেখিছিস না, দুইডো হাত নিই, আবার দুইটো পা-ও নিই, তারাও বাঁইচি থাকার জইন্নি কত কষ্ট সইহ্যি করতিছে? বাড়িত যাওয়ার কথা মুখি আনিসনি, পরে দেখা যাবি।” এভাবেই এক বছর পার হয়ে যায়। আলাল কাঁচপুর থেকে কমলাপুর যায়, ফোনের দোকান থেকে জামালকে ফোন করে জানতে পারে তার বাবা মারা গিয়েছে মাসখানেক আগে। ঘটনার পরে আলাল, হারু- দুজনের বাবাকেই পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, কয়েক দিন পরে ছেড়েও দেয়; তারপর থেকে তার বাবা মনের কষ্টে বাড়ির বাইরে আসা বন্ধ করে দেয়। উপার্জনবিহীন সংসারে তিনি আর বেশিদিন বাঁচেননি। মাকে ফোন করে নিশ্চিত হয় যে জামাল মিথ্যা বলেনি। মা কান্নাকাটি করে তার বাবার জন্য, সে যে কাজ করেছে তার জন্য গালমন্দও করে।

দিন কয়েক পরে আলাল স্বপ্নে দেখে তার বাবা তাকে নিতে এসেছে তার সাথে থাকার জন্য। অসুস্থ না হলে সাধারণত সে স্বপ্ন দেখে না। মৃত বাবাকে স্বপ্নে দেখে মনটা তার অস্থির হয়ে পড়ে। মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে জানতে চায় স্বপ্ন কি সত্যি হয়?
ইমাম সাহেব জানান, আল্লাহ’র ওলী-আউলিয়ারা স্বপ্নের মাধ্যমে অনেক কিছু জানতে পারেন। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তা ঘটে না। অসুস্থতার সময়ে প্রায় সব মানুষই নানা স্বপ্ন দেখে যা অর্থহীন। তবে কিছু স্বপ্ন অনেক ক্ষেত্রেই প্রমাণিত হয়েছে, যেমন: ঝড়-তুফান, সাপ দেখলে বিপদের সম্ভাবনা থাকে, সাপে কামড় দিচ্ছে দেখলে নিশ্চিত বিপদ, মৃত বা জীবিত বাবা-মাকে দেখলে নফল নামাজ পড়ে তাদের জন্য দোয়া করতে হয়। আলাল তার স্বপ্নের কথা জানায় ইমাম সাহেবকে। তিনি জিজ্ঞেস করেন “আপনার বাবা কি জীবিত না মৃত?” আলাল জানায় মৃত। ইমাম সাহেব কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বলে, “ স্বপ্নটা ভালো না, তওবার নামাজ পড়ে এই পৃথিবীতে যত গুনাহ করেছেন তার জন্য আল্লাহ’র কাছে মাফ চান। এখন থেকে আর কোনও পাপ কাজ করবেন না বলে মনস্থির করেন।”

আলাল জানে না তওবার নামাজ কিভাবে পড়তে হয়। এটাও বুঝতে পারল না, ইমাম সাহেব কেন তাকে তওবার নামাজ পড়তে বললেন। তার ইচ্ছে হলো বাবার কবর জিয়ারত করবে। দোয়া-কালাম না জানলেও বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বাবার কাছে ক্ষমা চাইবে। হারুকে বলাতে সে রাজি হলো না। পরপর কয়েকদিন বলার পরে সে-ও তার মাকে দেখার জন্য যেতে চাইল, দুজনে সিদ্ধান্ত নিল গভীর রাতে যেতে হবে।

বাসে করে গেলে মানুষ চিনে ফেলতে পারে। তারা খুলনাগামী ট্রেনে উঠল। এবার ছাদে না, টিকেট কেটে তৃতীয় শ্রেণির বগিতে। পোড়াদহে যখন নামল, তখন রাত এগারটা। ঘুটঘুইট্টা অন্ধকারে একটা ইজিবাইক ভাড়া করে গ্রাম থেকে দুই কিলোমিটার আগেই নেমে পড়ল। হেঁটে হেঁটে গ্রামের পথে চলল। আগে কবরস্থানে যাবে, তারপরে বাড়িতে মাকে দেখতে যাবে, চোখের দেখাটুকু অন্তত করে যাবে। ফজর হওয়ার আগেই গ্রাম ছাড়তে হবে। ছোট্ট কবরস্থানে এপাশে-ওপাশে বিদ্যুৎ বাতি লাগানো হয়েছে শিয়ালের হামলা থেকে কবরস্থান নিরাপদ করার জন্য। এদিক-সেদিক তাকিয়ে ওরা প্রায় নতুন একটা কবর দেখতে পায়। সেখানটায় যায় দুজনে। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আলালপাশে হারুকে নিয়ে দোয়া-কালাম যা জানে তা পড়ছে, চোখে তার অশ্রুধারা নেমেছে। হঠাৎ মনে হলো কে যেন পা জড়িয়ে ধরেছে। চোখ খুলেই সে ভয় পেয়ে যায়- সে যে কবরের সামনে দাঁড়িয়েছিল, এটাতো সে কবর না! একটা পুরাতন ধসে পড়া কবর। কবরের মধ্যে হাঁটু মুড়ে জবা উলঙ্গ শরীরে তার পা ধরে টানছে। সে দ্রুত সরে আসতে চায়, পারে না; জবা যেন লৌহকঠিন মুষ্ঠিতে তার পা ধরে রেখেছে। আলাল ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, পাশে তাকিয়ে অনুচ্চ স্বরে হারুকে ডাকে, “হারু তুই কোনে গেলি? দ্যাখতো কিডা আমার পা চাইপি ধইরিছে।” পাশে তাকিয়ে দেখে হারু মাথাটা পেছনে হেলিয়ে মুখটা আসমানের দিকে দিয়ে গোঙাচ্ছে। হারু কান্না নাকি প্রলাপের মতো বলে, “আমার পা-ও কিডা জানি চাইপি ধইরিছে, আমি আগেই তোক্ আসতে মানা করিছিলাম। তুই শনলি নে। এখুন কী হবিনি?” আলালের মনে হলো পায়ে কোনো কিছুতে কামড়েছে। আবারও হারুকে ডাকে সে, হারু তখন কাঁদছে আর বলছে “আল্লগো বাঁচাও মাইয়িডা কিডা?” অসহ্য যন্ত্রণায় আলাল ঝুঁকে বসে পড়ে দেখে পায়ের পাতার ওপর থেকে ছোটো দুটো ধারায় রক্ত গড়িয়ে নিচে পড়ছে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে, ঘুরছেও। আলাল বলে, “হারু দ্যাখতো সাপে কামাড়াইলো কিনা? রক্ত নাবেছে? মাথা ঘোরাচচে-রে।” অন্ধকারে হারু বসে পড়ে, আলালের পায়ে হাত দিয়ে দেখে সত্যিই রক্ত। সেও জিজ্ঞেস করে, “সাপেই কাইটলো নাকি-রে?” এদিক-সেদিক তাকাতেই হারু দেখে একটা সাপ তার পায়ের কাছেই বিশাল ফণা তুলে ভীষণ রাগে। ওরে বাবারে বলে চিৎকার দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই সাপটি তাকেও ছোবল মারে।


ফজরের নামাজ শেষে মুয়াজ্জিন আবুল হাশিম কবরস্থানে কতগুলো স্বাস্থ্যবান কুকুর দেখে; ওরা পরমানন্দে লাশ নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করছে, দুরে উদ্বিগ্ন চোখে কিছু শিয়ালও দেখে। মুয়াজ্জিন সাহেব জানেন এক মাস আগে কবরস্থানে লাশ দাফন হয়েছে। এর পরে তো আর কোনো লাশ দাফন হয়নি। তাহলে কুকুর-শিয়াল কী করছে এখানে? তিনি মুসল্লিদেরকে লাঠিসোটা নিয়ে এগোতে বললেন। জনা কয়েক মুসল্লি লাঠি যোগাড় করে এগোতেই প্রাণিগুলো ভয়ে কিংবা বিরক্ত হয়ে দূরে সরে গেল। মুসল্লিরা কাছে গিয়ে দেখে দুজন যুবকের মৃত দেহ। পেটের দিকটা কুকুরগুলো আগেই খেয়ে সাবাড় করেছে। মুখেও খাবলা দিয়েছে। কেউ একজন চিৎকার করে উঠল, “উয়ারে তো চিনতি পারিছি আমি- আলাল আর হারু।” সকলেই বিস্ময়াভিভূত হয়ে ইন্নালিল্লাহ পড়ে কুকুর শিয়াল তাড়াতে শশব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে এক বছরের মাথায় আবারও কবরস্থানে মানুষের ঢল নামল।